বৃহস্পতিবার   ১০ জুলাই ২০২৫   আষাঢ় ২৫ ১৪৩২   ১৪ মুহররম ১৪৪৭

ইরানের জয়ের খবর শুনেই হাসপাতালে রেজা পাহলভি

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:১৩ এএম, ২৬ জুন ২০২৫ বৃহস্পতিবার

অভূতপূর্ব এক ছবি-তেহরানের ইনকিলাব স্কয়ার। বারো দিন শেষে যুদ্ধবিরতির পর ইরানিদের উচ্ছাস-আনন্দগাথা, শোকগাথা প্রকাশের মিলনমেলার সাক্ষী হলো তেহরানের প্রাণকেন্দ্রে থাকা ঐতিহাসিক ইনকিলাব স্কয়ার। খামেনি সরকারের সেই বিজয় সুখের শক সইতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন রেজা পাহলভি।  

নেপথ্যে সুখের স্বপ্ন দেখা আমেরিকা প্রবাসী রেজা পাহলভির মেয়ে জানিয়েছে, তার বাবা গত কয়েক ঘণ্টা আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। যখন যুদ্ধবিরতির খবর তার কানে গেছে তখনই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। 

আজকে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে আগ্রাসন তার পেছনে রয়েছেন রেজা পাহলভি। যে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ হলো তার পেছনে তিনি আছেন। ইরানের শাসনব্যবস্থাকে বদলে দিয়ে আবার সেই পাহলভি শাসনে ফিরিয়ে নেওয়ার অলীক স্বপ্ন দেখছেন এই পাহলভি রাজপুত্র! কিন্তু সে স্বপ্নে গুড়ে বালি। ইরানের মানুষের কাছে তিনি এবং তার পূর্বসূরি খলনায়ক। ইরানের মানুষকে হত্যা করে এ দেশের মাটিতে তাদের ঠাঁই হবে না সে কথা ইরানি জাতির আজকের ছবি বলে দেয়।

ইরানের সামরিক-বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের অপরাধের প্রতিশোধ গ্রহণকারী ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রশংসা করতে তেহরানের ইনকিলাব স্কয়ারে জনতার ঢল নামে। হাজার হাজার মানুষ হাতে পতাকা, ইসলামি বিপ্লবের এবং শহীদদের ছবি নিয়ে বিজয় উদযাপনের খোলা ময়দানে হাজির হয়েছেন। নারী-পুরুষ ইরানের বিজয়ের স্লোগান দিয়েছেন। 

ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র নিপাত যাক, ধ্বংস হোক এ স্লোগানও তাদের কণ্ঠে। কারণ ওই আগ্রাসী দেশ দুটি তাদের ওপর আগ্রাসন চালিয়ে আসছে কয়েক যুগ ধরে ধারাবাহিকভাবে এবং নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে। তেহরানবাসী এ উদযাপনে তাদের শিশু সন্তানটিকে ঘরে রেখে আসেনি। কাঁধে শিশু সন্তান হাতে শহীদদের ছবি কিংবা ইরানের পতাকা-কী সে অভূতপূর্ব দৃশ্য! এ ছবি মনে করিয়ে দেয় তারা বিভক্ত নয়-এক এবং একাত্মতা। ইরানি জাতির এই একটি বিষয় দেখেছি সব সময়-ছোট্ট শিশুটিও বিপ্লবী। তারা জানে তাদের দেশমাকে, মাটিকে এবং সংস্কৃতিকে কীভাবে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে হয়। এ শিক্ষা বিশ্বের বহু দেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।

১২ দিনের যুদ্ধে ইরানের সর্বস্তরের মানুষের এ বিজয় উদযাপন ভুলিয়ে দেয় বিভীষিকাময় বারো দিনের কষ্টের কথা; ভুলিয়ে দেয় প্রতি মুহূর্তের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা। বারো দিন কেন, যদি এ যুদ্ধ বারো বছরও চলে কিংবা চলত তাতেও ইরানি জাতি বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হতো না, পেছন ফিরে তাকাত না। সর্বস্তরের ইরানি জনগণের মুখের ইস্পাত কঠিন ছবিই সে কথা বলে দেয়। তারা নিজের শরীরের রক্তের শেষবিন্দু দিয়ে হলেও মহান ইরানকে রক্ষা করত। এ জাতির অতীত ইতিহাসে এমন নজির ঢের আছে।

শুধু ইনকিলাব স্কয়ার নয়; তেহরানের আরও অনেক স্থানসহ ইরানজুড়ে তারা বিজয় মিছিল করেছে, তাদের সংহতির জানান দিয়েছে। তাদের সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা পোষণ করেছে।

বারো দিনের যুদ্ধের বিজয় উদযাপন ইরানের ভ‚খণ্ড পেরিয়ে মধ্যপ্রাচের আরও অনেক দেশ যারা দখলদার ইসরাইলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। রক্ত ও সম্পদ বিলিয়ে দিচ্ছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে গিয়ে। সেসব দেশেও বিজয় উদযাপনের আয়োজন করা হয়েছে। লেবাননের রাজধানী বৈরুতের উপকণ্ঠ দাহিয়েতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার ছবি দিয়ে বিশাল ব্যানার লাগানো হয়েছে। 

গাজা, ইয়েমেনসহ বিশ্বের যারাই ইরানকে ভালোবাসেন তারা খুশিতে কেউ বা আনন্দ অশ্রু ঝরিয়েছেন, কেউ বা আনন্দ মিছিলে যোগ দিয়েছেন কেউ বা তার খুশির বিষয়টি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করেছেন। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে ইরান যেন এক ফিনিস। সাম্রাজ্যবাদ, দখলদার শক্তি, অন্যায়, অত্যাচার, অনাচার, সন্ত্রাস ও মানবতার শত্রুদের বিরুদ্ধে একমাত্র ইরান একা দাঁড়িয়েছে বুক চিতিয়ে হয় তাদের হৃদয়ে কাঁপন ধরাতে, পরাজিত কিংবা পরাভ‚ত করতে না হয় শহীদ হতে।

অন্যদিকে পশ্চিমা মিডিয়ায় দেখা গেছে যে ছবি এবং কথা-সেটিকে কীভাবে বলা যাবে তা জানি না। তারা লিখেছে, নেতানিয়াহু বলেছেন, ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করেছি। বিজয়টা আসলে কারা অর্জন করেছে, কতটুকু অর্জন করেছে সেটি বোঝানোর জন্য কোনো বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয় না। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ তা অনেকটাই প্রত্যক্ষ করেছে। তবে এখানেই শেষ নয়!

মঙ্গলবার সংঘাতের বারো দিনের মাথায় যে যুদ্ধবিরতি হলো এবং সেটি মূলত প্রস্তাবটি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটি খবরের ভাষা ছিল এ রকম। ট্রাম্প আরব নেতাদের কাছে বার্তা দিয়েছেন, তারে বলে দিও (ইরানকে) ইসরাইল আর যুদ্ধ চালাতে চায় না। 

এ ঘটনা তেহরানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার পর যখন আকাশে সিঁদুরে মেঘ ঘনিয়ে উঠল ইরানের প্রতিশোধের আগুনের আঁচে তখন! তারপর ইরান কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা চালাল। তারপর যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তাদের পক্ষ থেকে! ইরান যুদ্ধবিরতিতে গেছে বটে তবে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে তাদের সবকিছুর ওপর। ইরানের ইসলামি বিপ্লবী বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ইরানের ওপর যদি আমেরিকা আর কোনো আগ্রাসন চালায় তার জবাব হবে ‘ঐতিহাসিক’।

যে কথা বলছিলাম এখানেই শেষ নয়! এর কারণ হচ্ছে-যুদ্ধবিরতিতে যাওয়ার পরও গতরাতে ইরানের বিভিন্ন স্থানে ইসরাইলের স্থানীয় এজেন্টদের হামলা থামেনি। বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ইসরাইলের সঙ্গে গত বারো দিনের যুদ্ধের মধ্যে গতকাল শেষ দিনে তেহরানে মোসাদের বেশ কয়েকজন এজেন্টকে নিরাপত্তা বাহিনী গ্রেফতার করেছে। 

তাদের কাছে বিস্ফোরকভর্তি ড্রোন, টাইম বোমা, গ্রেনেড, বন্দুকসহ অন্যান্য বিস্ফোরকও পাওয়া গেছে। এই এজেন্টরা ইরানের বিভিন্ন শহরে হামলা করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তাদের সে পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিয়েছে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী। হামলা করার আগেই এজেন্টদের শ্রীঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে জামাই আদর করার জন্য। এই বারো দিনে ৭শরও বেশি মোসাদের এজেন্ট ধরা পড়েছে। তাদের কারও কারও এরই মধ্যে বিচারের মাধ্যমে ফাঁসিও হয়েছে। 

তবে তাদের চক্র এখনো সব শেষ হয়েছে সে কথা বলার সুযোগ নেই-গতরাতের বিভিন্ন হামলা এবং আজ সকালেও বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণের শব্দ বলে দেয় এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে মোসাদের এজেন্ট ঘুরছে ইরানজুড়ে। তাদের কারণেই ইরানের মহাক্ষতি হয়েছে এ কদিনে। তবে যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল। 

ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর জোরদার অভিযানে সেটা খুব শিগগিরই প্রায় নির্মূল করা হয়তো সম্ভব। তাতে তেহরানসহ ইরানের স্বস্তিটা আরও নিশ্চিত হবে, মানুষের জীবন নিরাপদ হবে। অন্যদিকে যে আত্মতুষ্টির বিজয়ের কথা বলেছেন নেতানিয়াহু তাতে ছাই পড়বে।

দেখুন, বিশ্বের আমজনতা সুন্দর ও শান্তির পক্ষে। তারা অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম এবং আধিপত্যবাদ কিংবা সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে। ইরান সেই যুদ্ধের অগ্রনায়ক। সত্য ও সুন্দরের জয় হোক। বিশ্ব থেকে সব যুদ্ধ বন্ধ হোক। ভারসাম্যপূর্ণ মানবিক বিশ্বই আমাদের কাম্য।