রোববার   ১৫ জুন ২০২৫   জ্যৈষ্ঠ ৩১ ১৪৩২   ১৮ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

ভারতে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ২৪১ জন

আজকাল রিপোর্ট -

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৬:৫৮ এএম, ১৪ জুন ২০২৫ শনিবার

বিশ্বজুড়ে নেতৃবৃন্দের শোক প্রকাশ : বেঁচে গেলেন একজন

 
ভারতে আবার ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা। গুজরাতের আহমদাবাদ বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পরপরই গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান আবাসিক এলাকায় ছাত্রাবাস ভবনের ওপরে বিধ্বস্ত হয়। তাতে বিমানের ২৪২ জনের মধ্যে ২৪১ জন নিহত হয়েছেন। ১৯৮৮ সালে একই বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর ১৩০ জন যাত্রী নিহত হয়েছিলেন। গতকালের দুর্ঘটনা সারা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। ভারত সরকারের শীর্ষ মহল থেকে দুর্ঘটনার কোন স্পষ্ট কারণ জানানো হয়নি। বিমানটি লন্ডনের পথে যাত্রা করেছিল। ১২ বছরের পুরনো বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারটি বেলা ১:৩৮ মিনিটে টেক অফ করে। উপরে উঠার মতো শক্তি বিমানে ছিল না। তাই ৬শ ফিট উপর থেকে ৪০০ মাইল গতিতে নিচের দিকে পড়তে শুরু করে বিমানটি। পুরো বিমান জুড়ে জ্বালানি তেল ভর্তি  থাকায় একটি ভবনে ধাক্কা লাগার সঙ্গেসঙ্গে আগুনের লেলিহান শিখা আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে যায়। একজন ছাড়া সব যাত্রী পুড়ে মারা গেছেন। একমাত্র বেঁচে যাওয়া যাত্রী একজন পুরুষ। একজন মহিলা পথে দেরি হওয়ায় ওই বিমানের যাত্রী হতে পারেননি। তিনিও বেঁচে গেছেন। তবে  গুজরাতের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী রূপানি নিহত হয়েছেন। তিনি মেয়েকে দেখতে যাচ্ছিলেন।
নিহতদের ডিএনএ টেস্ট ছাড়া মরদেহ হস্তান্তর করা সম্ভব নয় বলে জানা গেছে। কারণ কোন যাত্রীকেই চেনা যাচ্ছে না। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় বিশ্বনেতৃবৃন্দ শোক জানিয়েছেন। এসব তথ্য জানিয়েছে, ভারতের দ্য হিন্দু, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এনডিটিভিসহ পাকিস্তানের দ্য ডন অন লাইন।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিমানবন্দরের নিকটবর্তী ডাক্তারদের একটি  হোস্টেল ভবনে গিয়ে ধাক্কা মারে বিমানটি। যার ফলে  হোস্টেল এবং তার আশপাশের ৫ জন নিহত হন বলে জানা যায়। ভেঙে পড়ার পরমুহূর্তেই প্রচ- শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। আগুন ধরে যায় বিমানে।  বিমানটি অহমদাবাদ থেকে লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। এদিকে এয়ার ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিমানে ২৩০ জন যাত্রী এবং ১২ জন ক্রু ও বিমানকর্মী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে দু’জন পাইলট। এই বিমানে ১৬৯ জন ভারতীয় ছিলেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ছিলেন ৫৩ জন ব্রিটিশ নাগরিক, ৭ জন পর্তুগিজ নাগরিক এবং ১ জন কানাডার নাগরিক। টাটা পরিবারের পক্ষ থেকে নিহত প্রতিজনকে এক কোটি রুপি দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। একজন মহিলা যাত্রী
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, বিমানটি ভেঙে পড়ার মুহূর্তে প্রচ- শব্দে চারপাশ কেঁপে ওঠে। অনেকেই ভেবেছিলেন ভূমিকম্প হচ্ছে। ঘটনাস্থলে লাশের স্তূপ জমে যায়। লাশ শনাক্ত করার জন্য ডিএনএ পরীক্ষার বন্দোবস্ত করেছে গুজরাত প্রশাসন। বিজে মেডিক্যাল কলেজে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে লাশ শনাক্তকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুর্ঘটনাগ্রস্তদের খবরাখবরের জন্য জনস্বার্থে চালু করা হয়েছে হেল্পলাইন নম্বর। গুজরাতের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপাণী অহমদাবাদের দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটিতে ছিলেন। লন্ডনে কন্যার কাছে যাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবর সন্ধ্যায় নিশ্চিত করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সিআর পাটিল। টাটা গোষ্ঠীর তরফে দুর্ঘটনায় মৃতদের পরিবারের জন্য এক কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হয়েছে।
অহমদাবাদের দুর্ঘটনায় এক জন মাত্র বেঁচে গিয়েছেন। বিমানটির ইকনমি ক্লাসের ‘১১এ’ আসনে বসেছিলেন ওই যাত্রী। নাম বিশ্বকুমার রমেশ। অহমদাবাদের পুলিশ কমিশনার জিএ মালিক সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে জানান, বিমানের একমাত্র জীবিত যাত্রী রমেশই। পুলিশ তাঁকে খুঁজে পেয়েছে। তিনি এখন হাসপাতালে রয়েছেন। ঘটনাস্থলের ভিডিওতে দেখা যায়, রমেশ হাঁটছেন। কয়েক জন মিলে তাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে খুব বেশি চোট তার লাগেনি। কীভাবে এমনটা সম্ভব হল তা ভেবে পাচ্ছেন না কেউ।
দুর্ঘটনার পর প্রথম যে ভিডিও প্রকাশ্যে আসে, তাতে দেখা যায়, যাত্রা শুরুর পর আবাসিক এলাকায় বেশ নীচ দিয়েই উড়ে যাচ্ছিল এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি। কিছুটা এগোনোর পরেই তা আচমকা নীচের দিকে নামতে শুরু করে। তারপর একটি ভবনে ধাক্কা খেয়ে বিমানটি ভেঙে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আগুন জ্বলে ওঠে। বিস্ফোরণের আঘাত এতটাই বেশি ছিল যে, আগুনের শিখা আকাশের অনেক উঁচু পর্যন্ত উঠে যায়। এর পর সন্ধ্যায় প্রকাশ্যে এসেছে বিমানবন্দরের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ। তাতে দেখা গিয়েছে, ওড়ার কিছুক্ষণ পরেই বিমানটি বাঁ দিকে হেলে পড়তে থাকে। একই সঙ্গে বিমানের লেজের অংশটি নীচের দিকে নামতে থাকে। বিশেষজ্ঞেরা প্রায় সকলেই একটি বিষয়ে একমত, বিমান ভেঙে পড়ার আসল কারণ জানা যাবে ব্ল্যাকবক্সটি উদ্ধার করা গেলে। এই মুহূর্তে তাই দুর্ঘটনার নিশ্চিত কারণ বলা সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, ওড়ার সময়ে যাত্রী, মালপত্রসহ বিমানের ওজন কত হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। প্রত্যেক বিমানের নির্দিষ্ট ভারবহন ক্ষমতা থাকে। কিন্তু অনেক সময়ে বিমান ওড়ার মুখে এই ওজনের হিসাবে গোলমাল করে ফেলেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। তখন বিমানটি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। বিমান বিশেষজ্ঞ বন্দনা সিংহ জানিয়েছেন, বিমানটি যে ভবনে ধাক্কা খেয়েছে, সেখানে তার একটি চাকা আটকে গিয়েছিল। ওজনের হিসাবে ভুল হলে এই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ার। বিশেষজ্ঞরা অনেকেই মনে করছেন, দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটির ল্যান্ডিং গিয়ারে ত্রুটি থাকতে পারে। হতে পারে, ল্যান্ডিং গিয়ারটি বিমান ওড়ার পর ঠিক মতো বন্ধ হয়নি। এই ল্যান্ডিং গিয়ারই বিমানের ভার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বিমান ওঠানামার সময় রানওয়ের সংস্পর্শে আসে ল্যান্ডিং গিয়ার। এখান থেকে বিমানের চাকা বেরিয়ে আসে। ফলে বিমানের গতিও ল্যান্ডিং গিয়ারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সেখানে গোলমালের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তৃতীয় কারণ হিসাবে অনেকে বলছেন, মাটি ছাড়ার পরেই বিমানের উপরের দিকে ওঠার ক্ষমতা (লিফ্ট) কমে এসেছিল। একসময় এই ক্ষমতা একেবারেই শেষ হয়ে আসে। তখন বিমানটিকে আর ভাসিয়ে রাখতে পারেননি পাইলট। ভিডিও দেখে অনেকে বলছেন, রানওয়ে ছাড়ার পর বিমানটি মাঝপথে সামান্য গোঁত্তা খেয়েছিল বলে মনে হচ্ছে। চতুর্থত, বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটির ইঞ্জিনে ত্রুটি ছিল। সেটি ভেঙে পড়ার আগে সর্বোচ্চ ৩২২ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টার গতিতে পৌঁছোতে পেরেছিল। যা একেবারেই স্বাভাবিক নয়। ওই সময়ে বিমানের গতি আরও অনেক বেশি হওয়ার কথা। কোনও কারণে বিমানের ইঞ্জিন শক্তি হারিয়ে ফেলে। তার ফলে দুর্ঘটনা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।
কী বললেন প্রধানমন্ত্রী মোদী: অহমদাবাদের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি লিখেছেন, ‘অহমদাবাদের দুর্ঘটনা আমাদের সকলকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। এই শোক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। যাঁরা এই দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, আমি তাঁদের সমবেদনা জানাচ্ছি। মন্ত্রীদের সঙ্গে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি।’
কী ঘটে থাকতে পারে ককপিটে: বিমান অহমদাবাদের মাটি ছাড়ার পরপরই ‘মে ডে কল’ পাঠিয়েছিলেন পাইলট। এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)-কে পাঠানো সেই বিপদবার্তায় কাজ হয়নি। বিমানটির সঙ্গে এটিসি যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আর যোগাযোগ করা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমানটি প্রয়োজনীয় গতিতে নির্দিষ্ট উচ্চতায় উঠতে পারছে না দেখে ককপিটে পাইলটেরা শেষ চেষ্টা করেছিলেন। হাতল টেনে ধরে বিমানটির নাকের অংশ তোলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি।
সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নিহত: লন্ডন গ্যাটউইকগামী বিমানটিতে গুজরাতের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা বিজয় রূপাণী ছিলেন। তিনি নিহত হয়েছেন। লন্ডনে কন্যার কাছে যাচ্ছিলেন তিনি। ২০১৬ থেকে ২০২১সাল পর্যন্ত রূপাণী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর পদে ছিলেন। তাঁর বৃহত্তর পরিবারের একটা অংশ কলকাতাতেও থাকে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ চত্বরে রূপাণীর তুতো ভাইয়ের দোকান আছে। রূপাণীর মৃত্যুর খবরে সেখানেও নেমেছে শোকের ছায়া।
এক মিনিটও সময় পাননি পাইলট: মাটি থেকে ৬২৫ ফুট মাত্র উঠতে পেরেছিল এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি। সেখান থেকেই এটিসি-কে পাঠানো হয়েছিল বিপদবার্তা। ফ্লাইট রাডার ২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, বিমানটি মিনিটে ৪০০ ফুট গতিতে নীচে নেমে আসছিল। তার পরেই আবাসিক এলাকায় ভেঙে পড়ে। পাইলটের হাতে এক মিনিটও সময় ছিল না। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, যদি বিমান ৩৫ হাজার ফুট উপরে থাকত, তা হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য কিছুটা সময় পেতেন পাইলট এবং ক্রু সদস্যেরা। এ ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়নি।