বাংলাদেশ সংকট
ঘরে-বাইরে চাপের মুখে ইউনূস
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:১২ এএম, ৭ জুন ২০২৫ শনিবার

গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে কঠিন সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। অর্ন্তবর্তি সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন অনুষ্ঠানে ডিসেম্বরের মধ্যে কী অগ্রগতি সাধন করেন সেদিকে তাকিয়ে প্রভাবশালী মহল। বিএনপি চায় ইউনূসই নির্বাচন করুন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করুক। কারণ, নির্বাচন হলে অনেকটা প্রতিপক্ষহীন ফাঁকা মাঠে গোল দেবার মতো পরিবেশে বিএনপিই একমাত্র পক্ষ। অর্ন্তবর্তি সরকার আওয়ামী লীগের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করে সেই পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সরকারের পথ ধরে নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন স্থগিত করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথও রুদ্ধ করেছে। ফলে মাঠে একমাত্র খেলোয়ার বিএনপি। বিএনপি তাই পানি ঘোলা না করে ভালোয় ভালোয় নির্বাচন চাইছে। তাছাড়া, ইউনূসের সামনে নির্বাচন দেওয়া ছাড়া কোনও পথও খোলা নেই। বিএনপি তাই ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ পলিসি নিয়েছে।
সেনাবাহিনী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ইউনূসের সরকারকে চাপে রেখেছে। সম্প্রতি অফিসার্স এড্রেসে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান একথা পুর্নব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের অভিলাশ নেই। শেখ হাসিনার পতনের আগে কিংবা পরে ক্ষমতা দখলের অনেক সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ক্ষমতা দখল করেনি। বরং সেনাপ্রধান বারবারই সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেবার লক্ষ্যে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন চাইছেন। তাছাড়া, বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের ইতিহাস থাকলেও তার পরিণতি খুব সুখকর নয়। ওয়ান ইলেভেনে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ের দুই প্রভাবশালীর কেউই দেশে থাকতে পারেননি। ফখরুদ্দীন ও মঈনুদ্দীন উভয়ে নির্বাসিত। জেনারেল ওয়াকারও তাই আগেভাগে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে গণতন্ত্রে উত্তরণের যে কোনও সংকটে নিজের দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন।
নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর আরেকটি বড় চাপ দেশের বাইরের শক্তির। প্রতিবেশি ভারত ইউনূসে খুব অস্বস্তিতে আছে। তিনি বিশে^র দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে এমন এক সম্পর্ক জালে আবদ্ধ করছেন যা ভারতকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। শেখ হাসিনার সময়েও এই দুইটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো। কিন্তু তখন ভারতের কাছে স্পর্শকাতর কোনও বিষয়ে বিগত সরকার অগ্রসর হয়নি। ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে একটা আস্থার ভাব ছিলো। এখন সেই আস্থা নেই। তাই ইউনূসের সবকাজে ভারত খূব সন্দেহ করে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে মুহাম্মদ ইউনূস খুবই অসতর্ক। তিনি চীন সফরকালে ভারতের উত্তর-পূর্ব সাত রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতার বিষয় সম্পর্কে মন্তব্য যুৎসই ছিল না। তিনি সর্বশেষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় ভারত তাকে উৎখাত করতে চায় বলে মন্তব্য করেছেন। তার এমন মন্তব্য মাহমুদুর রহমান মান্না বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সামনে প্রকাশ করেছেন।
ইউনূসের বিরুদ্ধে ভারত সরাসরি শক্ত কোনও পদক্ষেপ না নিলেও ভারতের প্রভাবশালী মিডিয়া প্রচারযুদ্ধে নেমেছে। পোশাক শিল্পের পণ্য রফতানির জন্যে ভারতের বিমানবন্দর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। স্থলপথে ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি বন্ধ করেছে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে ভারত বার্তা দিয়েছে যে, ইউনূসের কর্মকান্ড তাদের পছন্দ নয়। ভারত আশা করছে, একটা পর্যায়ে নির্বাচন নিয়ে ইউনূস দ্রুতই বিদায় নেবে। নির্বাচিত সরকার ভারতের সঙ্গে যোগাযো বাড়াবে। দিল্লি বাংলাদেশের পরিস্থিতির প্রতি নজর রাখছে। এখন পর্যন্ত ভারতের মূল্যায়ন হলো, বাংলাদেশে স্বল্প সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনিবার্য। তাই তড়িঘড়ি কোনও উপসংহারে না পৌঁছে অপেক্ষা করাই বাস্তবসম্মত।
রাখাইন রাজ্যে করিডর দেওয়া নিয়ে বেশ বিভ্রান্তিতে পড়েছে জনগণ। ইউনূসের সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য বাংলাদেশ একটি চ্যানেল দেবার জন্যে নীতিগত সম্মত হয়েছে। এই ধরনের সিদ্ধান্ত অর্ন্তবর্তি সরকারের এখতিয়ারে পড়ে না। বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক, কোনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ৯০ দিন। এই সরকার রুটিন কাজ পরিচালনা এবং নির্বাচন পরিচালনা করা দায়িত্ব। অর্ন্তবর্তি সরকার এতবড় নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সমীচীন নয়। কারণ রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি আছে। সেখানে আরাকান আর্মি নামের যে গ্রুপটি নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছে; ওই গ্রুপটি মূলত কট্টর বৌদ্ধদের গ্রুপ। আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাঠমান্ডু মিলিতভাবে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করেছে। এখন তাদের হাতে ত্রাণ পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের চ্যানেল দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভালভাবে নেয়নি মিয়ানমার। এ ব্যাপারে তারা প্রতিবাদ জানিয়েছে।
রোহিঙ্গা শব্দটা এসেছে আরবী ‘রহম’ থেকে এসেছে। ‘রহম’ মানে রহমত, রহম থেকে রোহান এবং তারপর রোহিঙ্গা। আরবের লোকেদের রাখাইন তথা আরাকান এলাকায় আসাকে রহমত হিসাবে গণ্য করা হয়েছিলো। কিন্তু কট্টর বৌদ্ধরা এটা মেনে নেয়নি। তারা রোহিঙ্গা শব্দ ব্যবহার করেনা। তারা বলে বাঙালী। তাদের ধারণা এরা চট্টগ্রাম থেকে রাখাইনে গেছে। ১৯৮২ সালে এক আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় অবস্থান করছে। রাখাইন রাজ্যে এখনও প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা রয়ে গেছেন। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবার ব্যাপারে কোনও অগ্রগতি না থাকলেও আরাকান আর্মিকে ত্রাণ দেবার জন্যে ইউনূস সরকারের মরিয়া ভাব সন্দেহের সৃষ্টি করেছে।
মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নিয়েও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, কলাকুশলি, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল, মুক্তিযুদ্ধকালে যেসব বাঙালী কর্মকর্তা বিদেশে বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিকভাবে অবদান রেখেছেন; তাদেরকে সহযোগি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অভিহিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন এই সিদ্ধান্ত বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অর্ন্তবর্তি সরকার নির্বাচন করার মতো মূল দায়িত্ব অগ্রাধিকারে নেবার বদলে বিতর্কিত নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ আলোচনায় আছে।
মুহাম্মদ ইউনূস লন্ডন সফরে যাচ্ছেন। সেখানে একটি দাতব্য সংস্থার পুরস্কার গ্রহণ করতে যাচ্ছেন তিনি। এক বছরেরও কম সময়ে তিনি এগারতম সফরে বিদেশে যাচ্ছেন তিনি। দেশের ভেতরে নানা সমস্যার সমাধানে মনযোগি না হলেও বিদেশ সফরে তার আগ্রহ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।