ইউনূস-ওয়াকারে অবিশ্বাসের দেয়াল
মনোয়ারুল ইসলাম/মাসুদ করিম
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৪৯ এএম, ২৪ মে ২০২৫ শনিবার

- ইউনূসের পদত্যাগের গুমকি
- শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি চারদিকে
- সেনাপ্রধান ডিসেম্বরেই নির্বাচন চান
- ওয়াকার-বিএনপি ঐকমত্য
- প্রেসিডেন্ট চুপ্পু নীরব
রাজপথে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। বিএনপি-এনসিপি পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিচ্ছে। উভয় দল তিনজন করে উপদেষ্টার অপসারণ চাইছে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাইছেন। অর্ন্তবর্তি সরকারের অনেক বিষয়ে সেনাবাহিনী ভিন্নমত পোষন করে। সরকারের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে করিডর দেবার পরিকল্পায়ও সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। যমুনা ও সেনাসদরের মুখোমুখি অবস্থান টালমাটাল এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। উদ্ভূত বেসামাল পরিস্থিতিতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। উপদেষ্টাদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা জানতে চান, রাজপথে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাদের কোনও করনীয় কিছু আছে কিনা। যদি করনীয় কিছু থাকে সেটা যেন তাকে জানায়। করনীয় না থাকলেও সেটাও যেন জানায়। এক পর্যায়ে তিনি পদত্যাগ করবেন বলে ঘোষণা দিলে সবাই তাকে পদত্যাগ না করার অনুরোধ জানায়।
কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে। দেশ কোন পথে যাচ্ছে। ইউনূস কি পদত্যাগ করছেন? তখন কি হবে? বিকল্প কোথায়? কে সামাল দেবেন? জামায়াতের রহস্যজনক আচরন। এনসিপিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার। রাজপথে বিএনপি। ইশরাকের রাজনৈতিক উত্থান ও রাজপথ দখল। পতিত আওয়ামী সরকারের দোসরদের সাবোটাজ পরিকল্পনা। সেনাপ্রধানের আলিটমেটাম। ইউনূস ও ওয়াকারুজ্জামানের মধ্যে অবিশ্বাসের দেয়াল। নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে বিতর্ক। এমনি এক শংকা ও উদ্বেগের মধ্যে দেশ। উদ্বিগ্ন সাধারন মানুষ। রাজনৈতিক দোষারোপের সংস্কতি ছেয়ে গেছে। কেউ কারো প্রতি সন্মান নিয়ে কথা বলছেন না। সেনাপ্রধান অর্ন্তবর্তিকালীন সরকার প্রধানের কর্তৃত্বকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করেছেন। ইউনূস মর্মাহত। ক্ষুব্ধ। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি চারিদিকে। প্রেসিডেন্ট চুপ্পু কোথায়? দেশে কোন রাষ্ট্র প্রধান আছেন। কেন তিনি হাইবারনেশনে? এমনি নানা প্রশ্ন সাধারন মানুষের। এই ক্রান্তিকালের মাঝিমাল্লাা কে?
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান এক বক্তৃতায় বাংলাদেশের রাজনীতির দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। অনিশ্চিত এক পরিস্থিতির মধ্যে তার দিক-নির্দেশনামূলক বক্তৃতা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে সহায়ক হবে। অর্ন্তবর্তি সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ পর্যন্ত সংকট উত্তরণের সুস্পষ্ট কোনও রোডম্যাপ দেননি। তিনি চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সম্প্রতি আল-জাজিরায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেছেন, জনগণ নির্বাচন চাইছেন না। এসব কারণে একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ওয়াকার। তার বক্তৃতায় জনআকাঙ্খার প্রতিফলন লক্ষ্যনীয়। সেনাবাহিনীর দরবারে তিনি এই বক্তৃতা দিয়েছেন। সেনাপ্রধানের বক্তৃতায় চারটি উল্লেখযোগ্য পয়েন্ট রয়েছে। এই চার পয়েন্ট হলো : ১. কাউকে করিডর দেওয়া যাবে না। এটা পুরোপুরি অগ্রহনযোগ্য। ২. ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচিত সরকারই জাতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। কোনও অনির্বাচিত সরকার না। ৩. স্বাধীনতা যুদ্ধ ও জাতীয় গৌরব কোনওভাবেই নেগোশিয়েটেবল না। ৪. মবসন্ত্রাস সেনাবাহিনী মেনে নেবে না। সেনাপ্রধান এই চারটি বিষয়ে যে বক্তব্য রেখেছেন উল্লেখযোগ্য।
এদিকে, আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ দফতর জানায়, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে প্রাণরক্ষায় রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ মোট ৬২৬ জনকে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় দেওয়া হয়। আশ্রয় দেওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করেছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। আশ্রয় দেওয়া ব্যক্তিদেও মধ্যে ২৪ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ৫ জন বিচারক, ১৯ জন বেসামরিক প্রশাসন কর্মকর্তা, ৫১৫ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য, বিভিন্ন পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের কর্মকর্তাসহ বিবিধ ১২ জন ও ৫১ জন পরিবার-পরিজন (স্ত্রী ও শিশুসহ) সর্বমোট ৬২৬ জনকে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিলো। বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ডরোধ, আইনের শাসন এবং জীবন রক্ষার লক্ষ্যে তাদেরকে সেনানিবাসে আশ্রয় দেওয়া হয়। সেনাবাহিনী ওই সকল ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করেছে।
উপদেষ্টা পরিষদের সাপ্তাহিক বৈঠক শেষে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সরকারি কর্মকর্তারা সভাস্থল ত্যাগ করেন। এরপর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা অনানুষ্ঠানিক বৈঠক শুরু করেন। এই বৈঠক চলে প্রায় চার ঘণ্টা। বৈঠকের এক পর্যায়ে উপদেষ্টাদের উদ্দেশে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে আজকেই (বৃহস্পতিবার) পদত্যাগ করব। এই জঞ্জালের দায় আর নিতে চাই না। ইতোমধ্যে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সবকিছুর পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন আছে। একাধিক উপদেষ্টা বৈঠকে একটি দলের কথা উলে¬খ করে বলেন-নির্বাচন কমিশনার, পুলিশ সুপার (এসপি) এবং জেলা প্রশাসক (ডিসি)সহ প্রশাসনের অধিকাংশ লোকই তাদের। এ অবস্থায় নির্বাচন দিলে তা হবে একটি সাজানো নির্বাচন। এই সাজানো নির্বাচনের দায় আমরা কেন নেব? এরপর জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের স্ক্রিপ্ট লেখা ও তা রেকর্ড করার আয়োজন শুরু হয়। তবে শেষ পর্যন্ত দু-একজন সিনিয়র উপদেষ্টা আরও দু-একদিন দেখার অনুরোধ করেন। আগামী শনিবার উপদেষ্টা পরিষদের একটি বৈঠক হওয়ার বিষয়ে আলোচনা রয়েছে।
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় রাজপথে পৃথক কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি ও এনসিপি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসাবে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের শপথ পড়ানোর দাবিতে তার নেতাকর্মীরা আন্দোলন করে আসছেন কয়েকদিন ধরে। তারা সরকারের ছাত্র প্রতিনিধি স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের পদত্যাগ দাবি করেন। যদিও বৃহস্পতিবার দুপুরে এ কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। এদিকে দুপুরে নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের পদত্যাগ দাবি করে বিএনপি। অপরদিকে এনসিপি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে বুধবার নির্বাচন কমিশন এবং বৃহস্পতিবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। দলটি আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে বিএনপিপন্থি আখ্যায়িত করে তাদের পদত্যাগে বাধ্য করার হুঁশিয়ারি দেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদ এ বৈঠক করল।
এদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল¬াহ পৃথক পৃথক ফেসবুক পোস্টে জুলাই ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির ঐক্যের আহ্বান জানান। তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার আগের বক্তব্যের শব্দ এবং বক্তব্যের যে অংশ বিভাজনমূলক ছিল, সে বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ‘ব্যক্তির আদর্শ, সম্মান ও আবেগের চেয়ে দেশ বড়’ শিরোনামে এক পোস্টে তিনি এ কথা উলে¬খ করেন।
ফেসবুক পোস্টে মাহফুজ আলম লেখেন, ‘দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য অনিবার্য। আগেকার যে কোনো বক্তব্য ও শব্দচয়ন, যা বিভাজনমূলক ছিল, সেগুলোর জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। সরকারে আর একদিনও থাকলে অভ্যুত্থানের সব শক্তির প্রতি সম্মান ও সংবেদনশীলতা রেখে কাজ করতে চাই।’ তিনি আরও লেখেন, ‘পুরাতন বন্দোবস্তের বিভেদকামী ¯ে¬াগান ও তকমাবাজি, যা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে হত্যাযোগ্য করে তোলে, সেগুলো পরিহার করলেই আশা করি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।’
হাসনাত আবদুল¬াহ তার ফেসবুক পোস্টে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি লেখেন, যে বিভাজনটা অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের মধ্যে এসেছিল, সেই বিভাজনকে দেশ ও জাতির স্বার্থে মিটিয়ে ফেলতে হবে। এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এবং পতিত ফ্যাসিবাদীদের নগ্ন দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তির জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের পর নাহিদ ইসলামের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ও রাজনৈতিক লিয়াজোঁ কমিটির প্রধান আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সন্ধ্যা ৭টায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় তাদের সাক্ষাৎকালে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। প্রধান উপদেষ্টা বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে চান। আলোচনায় নাহিদ ইসলাম এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা, দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে ভেবে দেখার আহ্বান জানান।