নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র
সেনাপ্রধানের রহস্যজনক নীরবতা!
মনোয়ারুল ইসলাম/মাসুদ করিম
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৩:২৭ এএম, ১৭ মে ২০২৫ শনিবার

বাংলাদেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। ১৮টি বছর বাংলাদেশ প্রকৃত নির্বাচনের কোন মুখ দেখেনি। নতুন প্রজন্ম দেখেনি নির্বাচনী উৎসব। দেখেছে দিনের ভোট রাতে দেবার নৃত্য। ৩০০ আসনের ১৫৪টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হবার বেহায়নার নির্লজ্জ হাসি। এমনি এক সন্ধিক্ষনে ১৮ কোটি মানুষ দেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছে। সংস্কারের জিকির, হাসিনার বিচার ও ইউনূস-এনসিপি ও জামাতের খোয়াবে নির্বাচন আদৌ হবে কিনা প্রশ্ন উঠেছে। ষড়যন্ত্র চলছে নির্বাচন নিয়ে। হঠাৎ করেই সেনা প্রধান ওয়াকারুজ্জামানের চুপসে যাওয়া ও নিরবতা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কোন কারনে তিনি আমেরিকা সফরে আসেন নি। তা নিয়েও প্রশ্নও উঠেছে। ৩০ দিনের মধ্যে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা নিয়ে টানাপেড়েন চলছে। সরকারের সুবিধাভোগী অংশীদার হয়ে যমুনা ঘেরাও নাটক দেখেছে জাতি। এনসিপির পতাকাতলে জামায়াত শিবির প্রতিশোধটি নিল আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিয়ে। ঐতিহ্যবাহী দলটি হারালো নির্বাচন কমিশনের রেজিস্ট্রেশন। ভারত এ নিষেধাজ্ঞায় নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে।
অর্ন্তবর্তি সরকার নির্বাচনের কোনও রোডম্যাপ এখনও দেয়নি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু আল-জাজিরায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, জনগণ নির্বাচন চাইছে না। ফলে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ এখনও অস্পষ্ট। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন বন্ধে নানা তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থা পরিস্থিতি ঘোলাটে হচ্ছে। বিভিন্ন পক্ষ আন্দোলনে নেমেছে। মিয়ানমারে মানবিক করিডোর দেবার কথা বলেও পরিস্থিতি খারাপ করা হচ্ছে। পাহাড়ে ও সমতলে নানা ইস্যু নতুন করে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। এসব অবস্থা থেকে দেশকে উত্তরণের লক্ষ্যে নির্বাচনমুখী তৎপরতা শুরু করার বদলে অর্ন্তবর্তি সরকার অন্য কাজে ব্যস্ত। ফলে অর্ন্তঘাতমুখী তৎপরতা বেড়েই চলেছে। এমন এক অচলায়তনের সুযোগে দেশি-বিদেশী মহল সক্রিয় হচ্ছে। তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে ব্যস্ত।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পর নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন স্থগিত করে দিয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে চলে গেছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। ভারত অর্ন্তভুক্তিমূলক নির্বাচন চাইছে। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা মামলার জালে আবদ্ধ হয়ে পলাতক আছেন। শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। ফলে তার পক্ষে বাংলাদেশে রাজনীতি করা এই মূহুর্তে অসম্ভব। বাংলাদেশে পরিবারভিত্তিক রাজনীতিতে শেখ হাসিনার উত্তরাধিকার কে হচ্ছেন সেই প্রশ্নও উঠছে। খালেদা জিয়া তার পুত্র তারেক রহমানকে রাজনীতির জন্যে তৈরী করেছেন। তারেক রহমান তার কন্যা ব্যারিষ্টার জাইমা রহমানকেও প্রস্তুত করছেন। শেখ হাসিনার পরিবারে সেভাবে কেউ গড়ে উঠেনি। জয় রাজনীতির মাঠে না থাকলে ভবিষ্যতে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল দলের কান্ডারী হতে পারেন - এমন মনে করা যায়।
দেশের রাজনীতি অনিশ্চিত পথে যাত্রা করেছে। আওয়ামী লীগের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। ঘনীভূত এই সংকট উত্তরণের চেয়ে নতুন নতুন সমস্যা যুক্ত হচ্ছে। নির্বাচনের রোডম্যাপ অজানা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্থিরতা বাড়ছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি নেই। ‘মব’ সহিংসতা থামানো যাচ্ছে না। সামাজিক মাধ্যমে অপতথ্যের ছড়াছড়ি। পরিবেশ বেশ গুমোট আকার ধারণ করেছে। অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান নেই। মধ্যবিত্তের জীবনে নেমেছে দুর্বিসহ দশা।
নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অর্ন্তবর্তি সরকার আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করেছে। গত ১১ মে উপদেষ্টা পরিষদের এক জরুরী বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে অর্ন্তবর্তি সরকারের আর্শিবাদপুষ্ট ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন নতুন রাজনৈতিক দল ‘ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি’ (এনসিপি) শাহবাগে বিক্ষোভ করেছে। এই ধরনের সংস্কৃতি আগেও দেখা গেছে। শেখ হাসিনার সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলাকালে তদানীন্তন সরকারের অনুগত ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ একইভাবে অবরোধ করে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের ফাঁসি দাবি করেছে। ওই সময়ে অনেক জামায়াত নেতারই ফাঁসি হয়।
আওয়ামী লীগের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ হবার পর এনসিপি এবং জামায়াতের মধ্যে মুখোমুখি অবস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির দলীয় শ্লোগানই শুধু নয়; বরং ‘গোলাম আজমের বাংলায়, আওয়ামী লীগের ঠাঁই নেই’ শ্লোগান দিয়েছে। জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাঁধা দিয়েছে। এই বিষয়ে এনসিপি বিবৃতি দিয়ে জামায়াত-শিবিরকে তুলোধুনো করেছে। অর্ন্তবর্তি সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম জামায়াত-শিবিরকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য প্রাঙ্গনে বড় জমায়েত করে এক সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মতো প্রতিবাদী কর্মসূচিও পালিত হয়েছে। জাতীয়তাবাদি ছাত্রদল নেতা সাম্য হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা নানা দাবিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছে। সেখানে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে লক্ষ্য করে পানির বোতল নিক্ষেপ করা হয়েছে।
গণঅভ্যূত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পতনের পর ইসলামী দলগুলোর উত্থান চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, চরমোনাই পীরসহ বিভিন্ন ইসলামী দল শুধু বড় বড় শোডাউন করছে এমন নয়; বরং নিষিদ্ধ ঘোষিত হিজবুত তাহিরের মতো নিষিদ্ধ দলও প্রকাশ্য মিছিল করেছে। তবে সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের সমালোচনা করতে গিয়ে নারীদের প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য সকলকে ক্ষুব্ধ করেছে। এটা ঠিক নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ইসলাম বিরোধী কতিপয় উপাদান রয়েছে। তাই বলে গোটা নারী সমাজকে অবমাননাকর মন্তব্য কাম্য নয়। এই বিষয়ে হেফাজতে ইসলাম অবশ্য পরে দুঃখ প্রকাশ করেছে।
সেনাবাহিনী সম্পর্কে নানা অপপ্রচারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছেয়ে গেছে। বঙ্গভবন, প্রধান উপদেষ্টার দফতর এবং সেনাসদরকে ঘিরে নানা প্রচারের বিষয়ে কর্তপক্ষের পর্যায়ে ব্যাখ্যা চোখে পড়ছে না। ফলে গুজবগুলো ডানা মেলছে। সারাদেশে বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনা মোতায়েন রয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা ছাড়া পুলিশের তৎপরতা নেই বললেই চলে। সেনা মোতায়েন থাকায় জনমনে কিছুটা আস্থার ভাব বিদ্যমান রয়েছে। সেনাবাহিনীর ইতিবাচক কর্মকান্ড তুলে ধরে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর সংক্ষেপে আইএসপিআর নতুন ভিডিও প্রকাশ করেছে। সামনের দিনগুলোতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হবে সেদিকে সবার নজর রয়েছে। অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, কালক্ষেপন না করে দ্রুত অর্ন্তভুক্তিমূলক নির্বাচনের পথে হাঁটাই সংকটের সমাধান। এই ক্ষেত্রে বিলম্ব করা হলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সমাজেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।