শর্ত বাস্তবায়ন না করলে ঋণ ছাড় নয়
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:২৯ এএম, ১৫ মে ২০২৫ বৃহস্পতিবার

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি নানাদিক থেকে এখনো চাপের মধ্যে রয়েছে। রিজার্ভ পরিস্থিতির এখনো উন্নতি হয়নি। কর জিডিপি অনুপাত এখন প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। আর্থিক খাত এখন যথেষ্ট দুর্বল। টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে এখনো বহু বাধা রয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে যথেষ্ট অর্থ খরচ করতে পারছে না। এই অবস্থা থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য সংস্কার কার্যক্রমগুলো দ্রুত সম্পন্ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ডলারের বাজারভিত্তিক বিনিময় হার দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সহায়ক হবে। যা আগামীতে অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাবে। রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। একটি শক্তিশালী ও প্রতিযোগিতামূলক আর্থিক খাত গড়ে তুলতে হবে। এসব সংস্কার বাস্তবায়নে সরকার আইএমএফকে প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। সরকারের গৃহীত সংস্কার কার্যক্রমের ওপরই চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় নির্ভর করবে। শর্ত বাস্তবায়ন না হলে ঋণের অর্থ ছাড় নাও হতে পারে।
বাংলাদেশ সময় বুধবার রাতে আইএমএফের সদর দপ্তর ওয়াশিংটন থেকে বাংলাদেশের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে দেওয়া এক বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়েছে। এর আগে গত সোমবার আইএমএফের সঙ্গে সরকারের একটি সমঝোতা হয়েছে। এর আওতায় আইএমএফ ঋণের কিস্তি ছাড় করতে সম্মত হয়েছে। পাশাপাশি সরকারও আইএমএফের ঋণের বেশ কিছু শর্ত বাস্তবায়নের বিষয়ে সম্মত হয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ভেঙে করনীতি ও কর ব্যবস্থাপনাকে আলাদা করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, বর্ধিত ঋণ সুবিধা, বর্ধিত তহবিল সুবিধা এবং স্থিতিস্থাপকতা ও টেকসই সুবিধা ব্যবস্থার বিষয়ে আইএমএফের তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যালোচনার বিষয়ে আইএমএফ মিশন সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে। এই মিশন বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে অর্জিত প্রাথমিক ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এটি আগামীতে আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডে উপস্থাপন করা হবে। তারা অনুমোদন করলেই কেবল ঋণের কিস্তি মিলতে পারে। আগামী জুনে নির্বাহী বোর্ডের বৈঠকে বাংলাদেশের ঋণের বিষয়টি উঠতে পারে। তবে আইএমএফ মিশনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতির ওপরই ঋণের কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে নির্বাহী বোর্ড থেকে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে টেকসই স্থিতিশীলতা অর্জন করতে সংস্কার কার্যক্রম কীভাবে চলমান থাকবে সে বিষয়ে একটি রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। বৈশ্বিক ও দেশীয়ভাবে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ এবং বৈদেশিক খাত থেকে অর্থায়নের চাহিদা বাড়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো চাপের মধ্যে রয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং বৈশ্বিক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে আইএমএফের কাছে ৭৬ কোটি ডলারের বাড়তি সহায়তা দেওয়ার অনুরোধ করে।
আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশ সরকার সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাদের প্রতিশ্র“তি পুনর্ব্যক্ত করেছে। যার মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক অর্থায়নের ঘাটতি মোকাবিলায় আর্থিক খাত সংস্কার, মূল্যস্ফীতির হার না কমা পর্যন্ত সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করতে হবে। পরিপূর্ণভাবে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার বাস্তবায়ন করতে হবে। একটি প্রতিযোগিতামূলক ও শক্তিশালী আর্থিক খাত গড়ে তোলার প্রতিশ্র“তি দিয়েছে সরকার। আর্থিক খাত পুনরুদ্ধারে দ্রুতগতিতে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সবুজ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য জলবাযু এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে হবে।
গত বছরের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরে প্রথমার্ধে প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যায়। দ্বিতীয়ার্ধে তা বৃদ্ধি পায়। তবে পুরো অর্থবছরের জন্য ৩ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। মূল্যস্ফীতির হার ডবল ডিজিটের কাছাকাছি থাকতে পারে।
আইএমএফ সরকারকে বলেছে, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত কম থাকায়, টেকসইভাবে রাজস্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি একটি ন্যায্য, আরও স্বচ্ছ এবং সহজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কর সংস্কারের জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। মূল অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে কর অব্যাহতি কমানো, কর আদায় বৃদ্ধি এবং প্রশাসন থেকে কর নীতিকে আলাদা করা। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমাতে হবে।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল করতে সুপরিকল্পিত কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। ক্ষুদ্র আমানতকারীদের সুরক্ষার পাশাপাশি সুশৃঙ্খল ব্যাংক পুনর্গঠন করতে হবে। নতুন আইনি কাঠামো কার্যকর করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ব্যাংকের জন্য শক্তিশালী সম্পদের মান পর্যালোচনা, ভবিষ্যৎমুখী কার্যকারিতার লক্ষ্যে ব্যাংক পুনর্গঠন, ঝুঁকিভিত্তিক তত্ত্বাবধান জোরদার করা এবং উন্নত প্রশাসন ও স্বচ্ছতা আস্থা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে।
একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও সুশাসন জোরদার করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে হবে। ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করতে, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে এবং তৈরি পোশাক খাতের বাইরে রপ্তানির ভিত্তি সম্প্রসারণের পদক্ষেপ নিতে হবে।
আইএমএফ বলেছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও আর্থিক ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এর আগে আইএমএফ মিশন গত বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশে এসে সরকারের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে। ওই সময়ে বলা হয়েছিল, ফেব্র“য়ারিতে কিস্তি ছাড় করবে। পরে তা পিছিয়ে মার্চে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু মার্চেও ছাড় করেনি। ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনার বিষয়টি গড়ায় ওয়াশিংটনে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বসন্তকালীন বৈঠকের সময় সাইডলাইনে আইএমএফের সঙ্গে সরকারের দুই দফা আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এতে কোনো সমঝোতা হয়নি। পরে অনলাইনে আরও দুই দফা বৈঠক হলেও কোনো সমঝোতা হয়নি। এ মাসেই আরও একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। এর আগেই বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনার ভিত্তিতে আইএমএফের শর্ত আংশিকভাবে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বিষয়টি আইএমএফকে জানালে তারা ঋণ ছাড়ে সম্মত হয়।