সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় ২৭% পদে লোক নেই
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৭:০২ এএম, ৭ মে ২০২৫ বুধবার

- অনুমোদিত পদ ২,৩৬,৮২৮, কর্মরত ১,৭৩,২৬১, শূন্য ৬৩,৫৭১
- গ্রামে শূন্যপদ ৪০%
- শহরে দেড় হাজার মানুষের একজন আর গ্রামে ১৫ হাজার মানুষের চিকিৎসক
- এসডিজি অর্জনে লাগবে ১০ হাজার মানুষের জন্য ৪৪.৫০ স্বাস্থ্য সেবাদানকারী, এখন আছে ১১.৭০ জন
- দ্রুত নিয়োগ শুরুর পরামর্শ
দেশের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোয় চিকিৎসক, নার্স ও প্যারামেডিকসহ সরাসরি স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত ২৭ শতাংশ পদ ফাঁকা। বর্তমানে প্রথম-২০তম গ্রেড পর্যন্ত এ ধরনের অনুমোদিত পদ ২ লাখ ৩৬ হাজার ৮২৮টি। এর মধ্যে বর্তমানে কর্মরত আছেন ১ লাখ ৭৩ হাজার ২৬১ জন। ৬৩ হাজার ৫৭১টি পদ শূন্য। তবে গ্রামাঞ্চলে এই ফাঁকা পদের হার ৪০ শতাংশ।
বিশেষ করে চিকিৎসক ঘাটতি এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। অনুমোদিত পদের বিপরীতে সাধারণ চিকিৎসকের ঘাটতি ২৫ শতাংশ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ঘাটতি ৫৮ শতাংশ। এ অবস্থায় বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি-৩) অর্জন থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, সব বয়সী মানুষের সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণে এসডিজি-৩ অর্জনের জন্য ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ৩১ দশমিক ৫ জন এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৪ দশমিক ৫ জন সেবা প্রদানকারী থাকার কথা। অথচ বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা দানকারী রয়েছেন ১১ দশমিক ৭০ জন।
অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে দেশের স্বাস্থ্যসেবা দানকারী জনবলের এই চিত্র উঠে এসেছে।
কমিশন বলেছে, চাহিদা মোতাবেক উৎপাদনে অক্ষমতা, প্রয়োজনীয় নীতিমালার অভাব এবং উপকরণের সীমাবদ্ধতার কারণে এসডিজি-৩ নির্দিষ্ট অনুপাতে অর্জন করা কঠিন। কমিশন ৩২টি প্রস্তাব সংবলিত তাদের প্রতিবেদন গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি ও কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের স্বাস্থ্য খাতে দুই ধরনের সমস্যা রয়েছে— তা হলো জনবল ঘাটতি ও অবকাঠামোগত সমস্যা। এ সমস্যা বেশ পুরনো। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সময় আছে আর পাঁচ বছর। আমরা যদি এখন থেকেও কাজ শুরু করি, তাহলেও ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার সবগুলো সূচক পূরণ করতে পারব না, কাছাকাছি যেতে পারব।’
এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, এসব ঘাটতি কাটাতে প্রথমেই অর্থের সংস্থান করতে হবে, যাতে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিয়ে তাদের হাতে যন্ত্রপাতি দিয়ে সেবার জন্য ছেড়ে দিতে পারি।
১৫ হাজার মানুষের একজন চিকিৎসক
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতের স্বল্প লোক বিতরণেও গ্রাম ও শহরাঞ্চলে অসামঞ্জস্য রয়েছে। বর্তমানে শহরে প্রতি ১৫০০ ও গ্রামাঞ্চলে প্রতি ১৫ হাজার মানুষের জন্য একজন চিকিৎসক রয়েছেন।
কমিশন স্বাস্থ্য খাতে এই অব্যবস্থাপনার জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জটিলতা, স্বচ্ছতার অভাব, পদায়ন ও পদোন্নতিতে স্থবিরতাকে চিহ্নিত করেছে। কমিশন দেখেছে, এ অব্যবস্থাপনার কারণে কর্মরত কর্মীদের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, সেবার মান কমে যাচ্ছে ও গ্রামাঞ্চলের মানুষ কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক ডা. আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, দেশের হাসপাতালগুলোর অবকাঠামো উপযুক্ত না। যেমন: ৪ হাজার ৭০০ ইউনিয়নের মধ্যে ১২০০-১৩০০ ইউনিয়নে চিকিৎসক ও ৩৩০০-এর মতো ইউনিয়নে স্বাস্থ্য সহকারী আছেন। ৫০০-এর মতো ইউনিয়নে সরকারিভাবে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার লোক নেই। মোট ইউনিয়নের মধ্যে ২০০-৩০০ ইউনিয়নে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক আছেন। বাকি প্রতিটি ইউনিয়নে গড়ে দুজন করে চিকিৎসক আছেন। একেকটা ইউনিয়নে ৩০ হাজারের মতো মানুষ। সেখানে দুজন চিকিৎসক, অর্থাৎ প্রতি ১৫ হাজার মানুষের জন্য একজন চিকিৎসক। একজন চিকিৎসকের পক্ষে এতগুলো মানুষের চিকিৎসা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৫ জন চিকিৎসক থাকার কথা।
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, আবার এই দুজন কিন্তু একই কাজ করছেন না। একজন সেবা দিচ্ছেন, আরেকজন বাকি কাজ করছেন। বলতে গেলে, ১৩০০ ইউনিয়নে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন একজন চিকিৎসক। তার মানে সবগুলো ইউনিয়নে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। এটা অবকাঠামোগত সমস্যা। এখন যথেষ্ট চিকিৎসক নেই। যারা আছেন, তারাও চিকিৎসার বাইরে অন্য কাজ করেন। ফিজিক্যাল অবকাঠামোর যে অবস্থা, সেখানে থাকার মতো অবস্থা নেই।
মা ও শিশুকেন্দ্রের রোগী যাচ্ছে উপজেলা ও সদরে
কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের প্রতিটি বিভাগে একটি করে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার বিভাগীয় পরিচালকের দপ্তর, ৬৪ জেলা সদরে একটি করে সিভিল সার্জন ও পরিবার পরিকল্পনার উপপরিচালকের দপ্তর, ৬৩টি জেলায় সদর হাসপাতাল, ৪৩২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ১ হাজার ৩৬২টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র, ৩ হাজার ২৯১টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ও ১৩ হাজার ৯২৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এগুলো চলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে।
অন্যদিকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীন পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের হাতে আছে ১০ শয্যার ২৮৮টি মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র। এর মধ্যে ১৬২টি ইউনিয়ন পর্যায়ে রয়েছে। এগুলো এখন ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হচ্ছে। এসব কেন্দ্রে দুজন করে চিকিৎসক থাকার কথা; কিন্তু তা নেই।
কমিশন বলছে, এসব মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
দুই ক্যাডারে দ্বন্দ্ব
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৫৫ হাজার। এর মধ্যে ৬০৩টি পদ আছে সাধারণ ক্যাডারভুক্ত। সেসব পদে কর্মরত আছেন ৩৩০ জন। অর্থাৎ ৪৫ শতাংশ পদ ফাঁকা। এ ছাড়া চিকিৎসকদের জন্য টেকনিক্যাল পদ রয়েছে ১ হাজার ১২০টি।
কমিশন দেখেছে, একই অধিদপ্তরের এই দুই ক্যাডারের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের অভাব রয়েছে। ফলে চিকিৎসায় বিঘ্ন ঘটছে।
কমিশন আরও বলেছে, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীনে ঢাকা শহরে চারটি বিশেষায়িত হাসপাতাল। সেখানে চিকিৎসক আছেন। তবে হাসপাতালে দায়িত্ব পালনের জন্য সহায়ক ও অনুকূল পরিবেশ নেই।
এ ছাড়া নগর এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে অন্যান্য কিছু মন্ত্রণালয়েরও কিছু হাসপাতাল, নার্সিং ও প্যারামেডিকেল ইনস্টিটিউট, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু এসবের অবস্থান ও সেবার পরিমাণ নগর এলাকার আয়োজনের সমানুপাতিক নয়।
কমিউনিটি ক্লিনিক চলছে একজন দিয়ে
অধ্যাপক ডা. আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক থাকার কথা। কিন্তু এখন ১৮ হাজার মানুষের জন্য একটি ক্লিনিক। প্রতিটি ক্লিনিকে মাত্র একজন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি)। তিনি ঝাড়– দিচ্ছেন, ক্লিনিক রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত করছেন, অনেক সময় বিদ্যুৎ বিল নিজের পকেট থেকে দিচ্ছেন, ওষুধ দিচ্ছেন, ওষুধের তালিকা রাখছেন, রোগীদের বিভিন্ন ধরনের সেবা দিচ্ছেন। এভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব না। এখানে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেওয়া হচ্ছে। বাকি যে তিনজন আছেন, তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন, ক্লিনিকে ঠিকমতো বসেন না। তার মানে যে জনবল ও অবকাঠামো আছে, সেটাও দক্ষভাবে ব্যবহার হচ্ছে না।
সংকট কাটাতে দ্রুত কাজ শুরুর পরামর্শ
বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে দুই ধরনের বড় সংকট দেখছেন অধ্যাপক ডা. আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন। তিনি বলেন, এগুলো হলো জনবল সংকট ও অবকাঠামো সমস্যা। এখন জনবল নিয়োগের উদ্যোগ শুরু হলেও নিয়োগ দিতে কমপক্ষে ছয় মাস থেকে এক বছর লাগবে। এরপর তাদের প্রশিক্ষণ লাগবে। যেমন— সাধারণত এমবিবিএস বা কনসালট্যান্ট চিকিৎসকরা একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু জনগণের আঙ্গিকে স্বাস্থ্য একটি নির্দিষ্ট বিষয় না।
জনগণের শিক্ষা, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি, অভ্যাস, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা, পেশা সব আঙ্গিক বিচার করেই একজন মানুষকে চিকিৎসা দিতে হবে। তাকে শুধু ক্লিনিক্যাল চিকিৎসা করলে হবে না। পরে সে ওই রোগ নিয়ে আবার আসবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে চিকিৎসা হয় না। নিয়োগ দেওয়ার পর কমপক্ষে তিন মাস প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
এরপর পোস্টিং স্থলে আশপাশের মানুষ, পরিবেশ সব বুঝে কাজ শুরু করবেন। সব মিলে কমপক্ষে দেড়-দুই বছর লাগবে। এমনকি কোথায় শূন্যপদে আছে, সেটা বের করতেও ছয় মাস লাগবে বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ।
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, শুধু চিকিৎসক হলেই হবে না। একজন চিকিৎসকের সঙ্গে তিনজন নার্স ও পাঁচজন প্যারামেডিক থাকার কথা। অন্তত দুজন নার্স ও তিনজন প্যারামেডিক থাকলেও হয়। দুজন নার্সের মধ্যে একজন নার্স ও আরেকজন মিডওয়াইফ বা ধাত্রী সহকারী। প্যারামেডিকদের একজন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন, একজন ওষুধ দেবেন, আরেকজন সুপারভাইজার হিসেবে থাকবেন। গার্ড ও অফিস সহকারী মিলে সাত-আটজন অন্যান্য কর্মী লাগবে। যারা আছেন, তাদের কারোরই থাকার ব্যবস্থা নেই।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, আরেক ধরনের জনবল লাগবে ব্যবস্থাপনার জন্য। তারা মনিটরিং করবেন যে কাজগুলো ঠিকমতো হচ্ছে কি না, মান ও পরিমাণ অনুযায়ী হচ্ছে কি না, স্বচ্ছতা আছে কি না, কেউ ফাঁকি দিচ্ছেন কি না। সেই ব্যবস্থাপক শ্রেণির জনবল নেই। যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। তারা দেখে দেখে শেখেন।