রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আশা ক্ষীণ হচ্ছে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৫৬ এএম, ৬ মে ২০২৫ মঙ্গলবার

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে সোমবার (৫ মে) পর্যন্ত নতুন করে ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে বলে সরকারি হিসাবেই বলা হয়েছে।
এর বাইরে বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি। যার মধ্যে আট লাখেরও বেশি এসেছে ২০১৭ সালের আগস্টের পর।
নতুন এই ঢলের পেছনে রয়েছে আরাকান আর্মি ও আরসার মধ্যে সংঘর্ষ, খাদ্য ও ওষুধ সংকট, সহিংসতা এবং রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক শ্রমে নিযুক্ত করার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘন। সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করলেও অনুপ্রবেশ থামছে না। ঢাকা ও নেপিদোর মধ্যকার প্রত্যাবাসন আলোচনা কার্যকর ফল আনতে পারেনি।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রাখাইনে আরাকান আর্মির সহিংসতায় সেখানে থাকা বাকি রোহিঙ্গারাও বাংলাদেশের অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। রাখাইনে পরিস্থিতি এ রকম চলতে থাকলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারাও ফিরে যেতে চাইবে না। ফলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কাছে কোনো সুযোগ নেই।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানো জরুরি। মিয়ানমারকে বাধ্য না করা গেলে এ সংকট বাংলাদেশের ওপর দীর্ঘস্থায়ী বোঝা হয়ে থাকবে।
গত বছরের ডিসেম্বর থেকে রাখাইনে নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হয়। আরাকান আর্মি মংডু টাউনশিপের দখল নিলেও, আরসা গেরিলা কৌশলে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ রোহিঙ্গাদের আরসাকে সহায়তা দেওয়ার সন্দেহে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা গ্রামবাসীর ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। হত্যা, গ্রাম উচ্ছেদ, খাদ্য লুট এবং জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করার কারণে বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।
কক্সবাজারে নিবন্ধন ও আশ্রয়শিবিরের বাস্তবতা
নতুন করে ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হয়েছে। তবে তাদের ঘর বরাদ্দ এখনো হয়নি। ফলে অনেকে আত্মীয় বা পরিচিতদের তাঁবুতে ঠাঁই নিচ্ছেন। বিদ্যমান ক্যাম্পগুলোতে থাকা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি। আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়ায় খাদ্য, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন ব্যবস্থায় অতিরিক্ত চাপ পড়েছে।
সীমান্ত নিরাপত্তা ও অনুপ্রবেশের পথ
বিজিবি ও কোস্ট গার্ড নাফ নদী ও স্থলসীমান্তে টহল বাড়িয়েছে। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত ৪৫ কিমি সীমান্তে কঠোর নজরদারি চলছে। তারপরও ২২টি চিহ্নিত স্থলপথ দিয়ে অনুপ্রবেশ হচ্ছে, বিশেষ করে রাতের আঁধারে। উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ি ও টেকনাফের দুর্গম এলাকাগুলো বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ।
সমুদ্রপথে আগমন
নতুন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গারা বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে ট্রলারে করে কক্সবাজার, মহেশখালী, চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী ও পতেঙ্গা উপক‚লে পৌঁছাচ্ছে। সম্প্রতি পতেঙ্গা থেকে র্যাব ৩৫ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে। সমুদ্রপথে আগমন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হলেও জীবন বাঁচাতে অনেকেই এই পথ নিচ্ছে।
প্রত্যাবাসন চেষ্টার ব্যর্থতা
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ কূটনৈতিক পর্যায়ে ধারাবাহিক চেষ্টা চালিয়ে আসছে। দ্বিপক্ষীয়ভাবে ঢাকা ও নেপিদো বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতায় পৌঁছালেও মিয়ানমারের পরিস্থিতি ও সদিচ্ছার অভাবে সেগুলো ফলপ্রসূ হয়নি। ২০১৮ ও ২০১৯ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গার নামের তালিকা দেয়, যার মধ্যে কয়েক ধাপে মাত্র ১ লাখ ৮০ হাজার জনকে যাচাই করে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে মিয়ানমার।
২০১৮, ২০১৯ ও ২০২৩ সালে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব ও ভিটেমাটির নিশ্চয়তা ছাড়া ফিরতে চায় না। মিয়ানমারে সামরিক সরকার এখনো রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করেনি। রাখাইনে নিয়ন্ত্রণও সেনাবাহিনীর নয়, বরং সশস্ত্র বিদ্রোহীদের হাতে। আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি।
২০২৩ সালের আগস্টে চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একটি ‘পাইলট প্রত্যাবাসন প্রকল্প’ চালুর সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, যার আওতায় প্রাথমিকভাবে প্রায় ১২,০০০ রোহিঙ্গাকে স্বেচ্ছায় ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা করা হয়। এরপর সেপ্টেম্বর ২০২৩-এ বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদল নেপিদো সফর করে এবং সেই বৈঠকে রাখাইনের মংডু এলাকায় ফেরত রোহিঙ্গাদের নিজ নিজ গ্রামে পুনর্বাসনের আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষদিকে রাখাইনে সংঘাত বৃদ্ধি ও ঘূর্ণিঝড় হামুনের প্রভাবে এই পরিকল্পনা স্থগিত হয়ে যায়। ২০২৪ ও ২০২৫ সালে একাধিকবার কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনার চেষ্টা হলেও মাঠপর্যায়ে প্রত্যাবাসন বাস্তবায়নের কোনো কার্যকর অগ্রগতি দেখা যায়নি।
এদিকে গত কয়েক বছরে বিমসটেক, আসিয়ানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা বিষয় তুলে ধরা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইসিসি মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা নিপীড়নের অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালত আইসিজে মিয়ানমারকে গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে। তবে এসব উদ্যোগ এখনো বাস্তবভিত্তিক পরিবর্তন আনতে পারেনি।
ভারত কৌশলগত কারণে মিয়ানমার বিষয়ে সরাসরি অবস্থান থেকে বিরত থেকেছে, তবে মানবিক সহায়তার নামে কিছু উদ্যোগ চালু রেখেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, ভারত এই সংকটে আরও সক্রিয় ভ‚মিকা নিক, বিশেষত আসিয়ান এবং বিমসটেক ফোরামে।
বর্তমানে রাখাইনে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করায় চীনের মধ্যস্থতায় করা সেই পাইলট প্রত্যাবাসন প্রকল্পও স্থগিত রয়েছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ে আঞ্চলিক ফোরাম বিমসটেক এবং আসিয়ান সংলাপেও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেছে। গত মাসে ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের সাইডলাইনে দুদেশের প্রতিনিধিদের সাক্ষাতে মিয়ানমার প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার শরণার্থীকে ফেরত নেওয়ার কথা আবার নিশ্চিত করে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আশা অনেকটাই অনিশ্চিত।
অভিবাসন ও শরণার্থীবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের বড় সমাধান হলো রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো। বর্তমানে যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো জরুরি। অবিলম্বে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়িয়ে এবং আন্তর্জাতিক চাপ নিশ্চিত করে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ফেরত গ্রহণে রাজি করানোই এ সংকট সমাধানের একমাত্র পথ।
বাংলাদেশের শরণার্থী কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, এত দিনের চেষ্টার পরেও একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি। ক্যাম্পে অবস্থিত আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সভাপতি মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, ‘রাখাইনে খাদ্যসংকটের মধ্যেও আরাকান আর্মি আমাদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই নির্যাতন মানুষকে সীমান্ত পেরোতে বাধ্য করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে একদিকে যেমন প্রত্যাবাসন অসম্ভব হয়ে পড়বে, তেমনি অনুপ্রবেশ ঠেকানোও মুশকিল হবে।’
সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান চাপ ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক বোঝা এবং সামাজিক প্রভাব সামলানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক‚টনীতিতেও দেশটিকে ভারসাম্য রক্ষা করতে হচ্ছে।