প্রকাশ্যে আসছেন পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৫৪ এএম, ৬ মে ২০২৫ মঙ্গলবার

কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈরিতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এ ঘটনার পর ভারতের মোকাবিলায় আড়াল থেকে প্রকাশ্যে আসছেন পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির। আড়ালে থেকে কাজ করতে পছন্দ করেন তিনি। তবে কাশ্মীরে হামলার পর ভারতবিরোধী কড়া ভাষায় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে নতুন করে উত্তেজনার মাত্রা বাড়িয়েছেন আসিম মুনির।
পটভূমি : হামলার পর প্রেক্ষাপট কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর চালানো হামলার ঘটনাটি ছিল সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী। ভারত দ্রুত পাকিস্তানকে এর জন্য দায়ী করে, যদিও ইসলামাবাদ এ অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে। তবে ভারতের অভ্যন্তরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার ও ডানপন্থি সমর্থকগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিশোধমূলক মনোভাব ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছে।
এই পরিস্থিতিতেই, অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির সামনে এসে ভারতকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানালেন। সামরিক মহড়ার সময় একটি ট্যাঙ্কের উপর দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ভারতের যেকোনো সামরিক দুঃসাহসের জবাব দেওয়া হবে কঠোর, দ্রুত এবং উচ্চতর মাত্রায়।
সামরিক মুখপাত্র থেকে রাজনৈতিক নেতা : আসিম মুনিরের উত্থান সাধারণত পাকিস্তানের সেনাপ্রধানগণ পর্দার আড়ালেই থাকেন, বিশেষ করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন অস্থিতিশীল থাকে। তবে মুনির ব্যতিক্রম। দেশের রাজনীতি যখন দুর্বল, অর্থনীতি বিপর্যস্ত এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বন্দি অবস্থায়, তখন মুনির সেনাবাহিনীর প্রভাবকে সামনে এনে নিজেকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেন।
ভারতকে মোকাবিলায় প্রকাশ্যে আসছেন পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি
তিনি শুধু একজন সেনাপ্রধান নন, বরং পাকিস্তানের ইতিহাসে বিরলভাবে দু’টি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী একজন কর্মকর্তা—আইএসআই এবং এমআই— যা তাকে এক অনন্য তথ্যভাণ্ডার ও ক্ষমতার জায়গায় দাঁড় করিয়েছে।
ধর্মীয় বয়ান এবং দুই জাতি তত্ত্বের পুনরুত্থান ২৬ এপ্রিল সেনা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে মুনির আবারো উচ্চারণ করেন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার মূল দর্শন—দ্বিজাতি তত্ত্ব। তিনি বলেন, হিন্দু ও মুসলমান দুটি স্বতন্ত্র জাতি এবং এই বিশ্বাস থেকেই পাকিস্তানের জন্ম। এই মন্তব্য শুধু ঐতিহাসিক ভিত্তিই নয়, তা বর্তমান দ্বন্দ্বের একটি ধর্মীয় মাত্রাও তৈরি করে।
আরো তাৎপর্যপূর্ণ হলো, মুনির কাশ্মীরকে আখ্যা দেন পাকিস্তানের জাগুলার ভেইন বা জীবনীশক্তির ধমনী হিসেবে। এটি পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের একটি শক্তিশালী প্রতীক। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বক্তব্যকে উস্কানিমূলক হিসেবে অভিহিত করেছে এবং কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে পুনরায় ঘোষণা করেছে।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপট : রাজনীতি ও সেনাবাহিনীর আধিপত্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানে সেনাবাহিনী আবারো দৃঢ়ভাবে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। ইমরান খানের পতনের পেছনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল সুস্পষ্ট। তার বিরোধিতা করার কারণে মুনির ক্ষমতায় আসার পর থেকে খানকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে এবং তার দল পিটিআই কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
এই অবস্থায় মুনির নিজেকে শুধু সেনাপ্রধান হিসেবে নয়, রাষ্ট্রের প্রধান অভিভাবক হিসেবেও তুলে ধরতে চাইছেন। বিশ্লেষকদের মতে, তিনি জনপ্রিয়তা নয়, নিয়ন্ত্রণ চান।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক সমীকরণ ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই পরমাণু শক্তিধর হওয়ায় আন্তর্জাতিক মহল উদ্বিগ্ন। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে। তবে এরই মধ্যে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ জোরদার করেছে। বেইজিং, যেহেতু পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অংশীদার, তাই ইসলামাবাদ তাদের কূটনৈতিক সহায়তা পাওয়ার আশা করছে।
তবে ভারত এই মুহূর্তে চীনের চাপকে উপেক্ষা করতে পারে বলেই অনেকে মনে করছেন, কারণ মোদি সরকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসী।
ভারতের জবাব : নরেন্দ্র মোদির হুঁশিয়ারি কাশ্মীরে অতীতের হামলার (২০১৬ ও ২০১৯) পর ভারতের জবাব ছিল প্রত্যুত্তরমূলক বিমান হামলা। কিন্তু এবার পরিস্থিতি আরও জটিল। পর্যটকদের উপর হামলা সরাসরি বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে, এবং এটা মোদির সমর্থকদের মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা আরও উসকে দিয়েছে। মোদি বলেছেন, সন্ত্রাসী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের আমরা পৃথিবীর শেষ প্রান্তেও খুঁজে বের করব।
এই বার্তা কেবল পাকিস্তানের দিকে নয়, বরং ভারতের অভ্যন্তরেও এক ধরনের ‘শক্তিশালী নেতা’ ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করছে, বিশেষ করে যখন দেশজুড়ে নির্বাচনী উত্তাপ।
বিশ্লেষণ : যুদ্ধ নাকি কূটনীতি? বিশ্লেষকরা বলছেন, উভয় পক্ষের আক্রমণাত্মক বক্তব্য ও পদক্ষেপ এক গভীর সংকটের দিকে নিয়ে যেতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহিদ হোসেন মনে করেন, যদি ভারত সীমিত হামলা চালায়, তাহলে পাকিস্তান প্রতিক্রিয়া দেখাতেই বাধ্য হবে। আর এ থেকেই বড় ধরনের সংঘর্ষ শুরু হতে পারে।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, একমাত্র শক্তিশালী কূটনৈতিক উদ্যোগই পারে এই পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে।