রোববার   ০৪ মে ২০২৫   বৈশাখ ২০ ১৪৩২   ০৬ জ্বিলকদ ১৪৪৬

রাখাইনে মানবিক করিডর সংঘাতে জড়াতে পারে বাংলাদেশ

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৫:০৯ এএম, ৩ মে ২০২৫ শনিবার



মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ সরবরাহের জন্য মানবিক করিডর দেবার জন্য জাতিসংঘের প্রস্তাবে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, কিছু শর্তে রাখাইনে জাতিসংঘের ত্রাণ সরবরাহে প্যাসেস দিতে বাংলাদেশ নীতিগত সম্মত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তি সরকারের এই মানবিক করিডর নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা কী তা স্পষ্ট করেনি। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মানবিক করিডর বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হতে পারে। এক পর্যায়ে অহেতুক সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে বাংলাদেশ। এটা বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেত। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বাংলাদেশ যেন আরেকটি গাজায় পরিণত না হয়। রাখাইনে মানবিক করিডর দেবার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন ছিলো। জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রায় একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। কিন্তু সরকার সিদ্ধান্তে অটল।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চল এখন আরাকান আর্মির দখলে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তি প্রায় পুরোটাই এই সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দখলে চলে গেছে। আরাকান আর্মি একটি রোহিঙ্গা বিরোধী গোষ্ঠী। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন সম্প্রদায়ের এই গ্রুপটি রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন পীড়ন চালিয়ে বিতাড়িত করেছে। রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর দেবার জাতিসংঘের প্রস্তাবের মধ্যেও সেখান থেকে নতুন করে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। রাখাইনে মানবিক করিডর দেবার শর্তের মধ্যে রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবার কোনও শর্ত নেই। ত্রাণ সকল গোষ্ঠীর মধ্যে বিতরণের শর্ত রয়েছে। অর্থাৎ আরাকান আর্মি বৌদ্ধ হলেও সেখানে এখনও থেকে যাওয়া রোহিঙ্গারাও যাতে ত্রাণ পায় সেই ব্যবস্থা করার শর্ত রয়েছে। ২০১০ সালে গড়ে ওঠা আরাকান আর্মি মিয়ানমারের কাচিন বিদ্রোহী গোষ্ঠী কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি (কেআইএ)-এর কাছে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বিমান হামলা পরিচালনা করলেও গেরিলা যুদ্ধ করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। কোভিড-১৯ মহামারিকালে ক্ষমতার শূন্যতার সুযোগ নিয়ে আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চল দখলে নেয়। ২০২৪ সালে আরাকান আর্মি ঘোষণা করে যে, তারা রাখাইন রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নিয়েছে। আরাকান আর্মি দাবি করেছে যে, তাদের সৈন্য সংখ্যা ৪৫ হাজার।
রাখাইন রাজ্যে ভারতের কালাদান মাল্টিমুডাল প্রকল্প রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিজোরাম থেকে ভারতের অন্য অংশে সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে মিয়ানমারের কালাদান নদীর ওপর দিয়ে এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষ না হতেই আরাকান আর্মি রাখাইনে তাদের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করেছে। ফলে প্রকল্পটিকে অক্ষত রাখতে ভারত আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে।
আরাকান আর্মি একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তাই বাংলাদেশের পক্ষে সরকারীভাবে এই গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব নয়। আরাকান আর্মির সহায়তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়। এ কারণে বাংলাদেশও আরাকান আর্মির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ স্থাপন করেছে। তবে জাতিসংঘ বলছে, রাখাইন রাজ্যে দুর্ভিক্ষ হতে পারে। এই আশঙ্কা থেকে তারা সেখানে ত্রান সামগ্রী পাঠাতে চায়। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকালে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ত্রাণ পাঠানোর প্রস্তাব করেন। বাংলাদেশ এই বিষয়ে মন্ত্রিসভায় কোনও আলোচনা না করেই নীতিগত সম্মতির কথা জানায়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও কোনও আলোচনা করেনি অর্ন্তবর্তি সরকার।
রাখাইনে মানবিক করিডর দেওয়া হলে বাংলাদেশের তেমন কোনও সুফলের কথা কেউ বলতে পারেনি। তবে অনেকগুলো আশঙ্কার কথা বলেছেন অনেকে। মানবিক করিডরের নামে ভবিষ্যতের সামরিক ঘাঁটির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে কিনা এই প্রশ্ন করা হচ্ছে। তারা বলছেন, টেকনাফ সীমান্তে জাতিসংঘ যে মানবিক করিডর চাচ্ছে, তার প্রভাব হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি, ভয়ংকর এবং অনুশোচনামূলক।
বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা যুদ্ধের সময় জাতিসংঘ মানবিক করিডর বানিয়েছিলো। তার ফলে সেখানে স্থায়ী ন্যাটো ঘাঁটি স্থাপিত হয়েছে। ইরাকে ‘নো ফ্লাই জোন’ নামে তৈরী করা হয়েছিলো মানবিক করিডর। তার ফলে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ও দীর্ঘ মেয়াদি দখল। ২০১১ সালে মানবিক সহায়তা এবং নাগরিক সুরক্ষার নামে ন্যাটো ও জাতিসংঘ লিবিয়ার বেনগাজিতে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা করে। লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পথ তৈরী করে এবং দেশটিকে টুকরো টুকরো করে দেয়। আজ অবধি লিবিয়া আর একটা র্পূণাঙ্গ রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি।
সিরিয়ার আলেপ্পো, ইদলিব ও রাকা অঞ্চলে মানবিক করিডরের প্রতিষ্ঠার নামে যে পশ্চিমাদের অভ্যন্তরীণ করিডর তৈরী করা হয়েছিলো। তার ফলে সিরিয়ায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলেছে গৃহযুদ্ধ। আফগানিস্তানেও শুরুটা হয়েছিলোমানবিক সহায়তা দিয়ে, শেষটা কোথায় গেছে আমরা সবাই জানি। আজ টেকনাফ সীমান্তে যে হিউম্যাটেনিয়ারিয়ান করিডর গঠনের আলোচনা চলছে, তা আদতে একটি নতুন বাফার জোন তৈরীর সূচনা হতে পারে। সেই করিডওে জাতিসংঘ থাকবে, আন্তর্জাতিক এনজিও থাকবে, থাকবে বিদেশী পর্যবেক্ষক, বিদেশী কনভয়। ফলে বাংলাদেশের সীমান্তের একাংশে নিজস্ব সার্বভৌমত্ব কর্তৃত্ব হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।