শনিবার   ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আশ্বিন ৫ ১৪৩২   ২৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

মাষকলাই ডালের বড়ি বদলে দিয়েছে তাদের ভাগ্য

লাইফস্টাইল ডেস্ক

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৯:৩৪ পিএম, ৭ জানুয়ারি ২০১৯ সোমবার

মাষকলাই ডালের বড়ির চাহিদা থাকে বছর জুড়েই। তবে শীত মৌসুমে এর চাহিদা বাড়ে। এ সময় গ্রামের হাটবাজারে এ বড়ি বেশি দেখা যায়। শহরেও এখন এর জনপ্রিয়তা রয়েছে।

 

ব্যাপক চাহিদা আছে বলেই ডালের বড়ি বানিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী, টানমুশরী ও কাঞ্চন এলাকার নারীরা। ডালের বড়ি তৈরি করে তা পাইকারদের কাছে বিক্রি করে জীবিকা চালাচ্ছেন তারা।

দশ ঘণ্টা ভেজানো মাষকলাই ডাল পাটায় পিষছিলেন রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী গ্রামের বজ বালা (৬০)। ডাল পেষা শেষ হতেই তা ভালো করে ফেটিয়ে নেন। উঠানে রোদে বসে টিনে নারিকেল তেল মাখিয়ে তাতে ডালের বড়ি দিতে থাকেন।

দু-তিন দিন রোদে শুকাবেন। পুরোপুরি শুকালে তা সংরক্ষণ করবেন। পুত্রবধূ, নাতি-নাতনিরাও তাকে সহযোগিতা করছেন। তার হাতের ছোঁয়ায় টানমুশরী, কাঞ্চনের মেয়েরাও মাষকলাই ডালের বড়ি তৈরি করে রোজগার করছেন। এ গ্রাম তিনটি এখন ‘মাষকলাইয়ের বড়ির গ্রাম’ নামে পরিচিত।

উত্তরপাড়া গ্রামের জীবন চন্দ্রের সঙ্গে তার বিয়ে হয় বাষট্টি সালে। অর্ধহারে-অনাহারে চলত তাদের দিন। ঊননব্বই সালে স্বামী মারা গেলে তিন সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েন বজ বালা। অন্যের বাড়িতে ধান ভেনে যে টাকা পেতেন তাতে সংসার চলত না। শাকপাতা খেয়ে দিন কাটত তাদের।

একপর্যায়ে দেবর রবী রায় তাকে মাষকলাইয়ের বড়ি বানিয়ে বিক্রি করার পরামর্শ দেন। ’৯০-এর দশকে বজ বালা বাজার থেকে ১৫ কেজি মাষকলাই কিনে এনে বড়ি বানিয়ে বিক্রি করেন। এতে লাভ হয় ৩০০ টাকা।

এরপর থেকে বজ বালা বড়ি বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। মাত্র দেড় বছরেই ব্যবসা জমে ওঠে। মুনাফার টাকায় তিনি দুটি গাভী, তিনটি ছাগল, হাঁস-মুরগি কিনে লালন পালন করেন। এভাবেই ঘুচে যায় তার সংসারের দৈন্যদশা।

বড়ি বিক্রির টাকায় বজ বালা মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলেকে ঘর তুলে দিয়েছেন। কিনেছেন দুই বিঘা জমি। পুকুরে মাছ চাষ করছেন।

দিনে কত কেজি মাষকলাই ডালের বড়ি তৈরি করতে পারেন এ প্রসঙ্গে ব্রজবালা বলেন, একজনের পক্ষে দিনে পাঁচ কেজি বড়ি তৈরি করা সম্ভব। দশ কেজি মাষকলাইয়ে নয় কেজি বড়ি হয়। পাইকাররা গ্রামে এসে বড়ি কিনে নিয়ে যায়। প্রতি কেজি বড়ি তৈরিতে ১৬০-২০০ টাকা খরচ হয়। বিক্রি হয় ৩০০-৩৫০ টাকায়।

সুখের দিনগুলোতেও তিনি তার দুঃখের কথা ভোলেননি। মাষকলাই ডালের বড়ি তৈরি করেই তিনি থেমে থাকেননি। তিনি গ্রামে ঘুরে ঘুরে দুস্থ মেয়েদের বড়ি তৈরি করা শিখিয়ে স্বনির্ভর হতে সহযোগিতা করছেন।

রূপগঞ্জের বড়িপল্লীর লোকজনের কাছে বজ বালা এখন মডেল। বজ বালার পথ অনুসরণ করে অনিতা রানী (৩৫) বড়ি তৈরিকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। স্বামী দিরেন্দ্রের মৃত্যুর পর তিন সন্তানকে নিয়ে কষ্টে দিন কাটছিল তার।

বজ বালার কাছ থেকে বড়ি তৈরির কৌশল শেখেন। প্রতি মাসে হাজার দশেক টাকা আয় করেন। সন্তানদের পড়াশোনা শেখাচ্ছেন। বাড়িতে টিনের ঘর তুলেছেন। দুটি ছাগল ও ৫ শতক জমি কিনেছেন।

অন্ধ স্বামী, দুই ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে মনিকা রানীর সংসার। মাষকলাই ডালের বড়ির বিক্রির টাকায় তার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে। তিনিও টিনের ঘর তুলেছেন, জমি কিনেছেন, হাঁস-মুরগি পালন করছেন।

একইভাবে বজ বালার পথ ধরে সংসারের উন্নতি ঘটিয়েছেন শিখারানী, মালতি রানী, সাবিত্রী, পলিবালা, শিল্পী রানী, ছবি রানী, বিন্দু রানী, মলিকা রানীসহ অনেকেই।

পলিবালা কলেজে পড়ছেন। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বড়ি তৈরি করেন। অভাবের সংসারে স্কুলে প্রায়ই তাকে না খেয়ে যেতে হতো। এখন দিন বদলেছে। পড়াশোনার খরচ তো চলছেই, বড়ি থেকে আয়ের টাকা তিনি সংসারে দিচ্ছেন।

একইভাবে বড়ি তৈরি করে পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছে দিপালী রানী, ববিতা রানী, মায়া রানীসহ অনেকে।