আঁধারেই থাকছেন নীতিনির্ধারকরা
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:২২ এএম, ৭ মার্চ ২০২৫ শুক্রবার

মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের কার্যাবলীর বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি হয়নি
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের গত অর্থবছরের কার্যাবলীর বার্ষিক প্রতিবেদন প্রণয়ন করেনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সরকারের কার্যাবলী বিষয়ক এ প্রতিবেদন মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের রেওয়াজ রয়েছে। প্রতিবেদন না করায় উপদেষ্টা, সচিব ও অন্যান্য নীতিনির্ধারক কর্মকর্তা, যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সরকারের স্থানীয় ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ বিষয়ে জানতে পারছেন না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ কথা জানিয়েছেন।
বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যেমন বছরভিত্তিক ব্যালেন্স শিট তৈরি করা হয় ঠিক তেমনি সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, সংস্থা, করপোরেশন, বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের কাজের বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। সাধারণত নভেম্বর মাসে আগের অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন মন্ত্রিসভা বা উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হয় এবং অনুমোদন নেওয়া হয়। সব মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করার পর তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়।
বার্ষিক প্রতিবেদনে কী কী প্রতিকূল পরিস্থিতি পাড়ি দেওয়া হয়েছে তার উল্লেখ থাকে। পরের বছরে সরকারকে যেসব স্থানীয় ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে সে বিষয়ক সতর্কবার্তাও প্রতিবেদনে থাকে। এর থেকেই মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো তাদের কর্মকৌশল ঠিক করে। একই সঙ্গে লোকসানি প্রতিষ্ঠানের লোকসানের পরিমাণ ও কারণের ব্যাখ্যাও থাকে। লোকসানি অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কর্ম পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ থাকে প্রতিবেদনে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য যেসব উদ্যোগ নেয় তা সাধারণত অজানা থাকে নীতি নির্ধারকদের। বার্ষিক প্রতিবেদনে দুদক সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে যে অনিয়ম পায় তা উল্লেখ করা হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ইয়াসমিন বেগম এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়নি, এটা ঠিক। তবে এ প্রতিবেদন উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদিত হতে হবে এমন কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই।’
মন্ত্রিসভার বৈঠকে সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহের কার্যাবলী সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুমোদিত হয়েছে। এর পরে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুমোদিত হওয়ার কথা। ৩০ জুন অর্থবছর শেষ হয়। কিন্তু বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করতে এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন সংগ্রহ ও সমন্বয় করতে চার থেকে পাঁচ মাস সময় লাগে। নভেম্বরে সে প্রতিবেদন মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সব মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন সংগ্রহ করলেও সেসবের সমন্বয় করেনি। এর মধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা পেয়ে প্রতিবেদন সমন্বয়ের কাজ স্থগিত করে দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
সাবেক সচিব আবদুল আউয়াল মজুমদার এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এবার বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করার পরিবেশ ছিল না। প্রতিবেদন তৈরিতে অনেক কাজ করতে হয়। এর জন্য কিছু কর্মকর্তার সমন্বয়ে দল গঠন করে দেওয়া হয়। তবে সময়মত করা না গেলেও এখন বার্ষিক প্রতিবেদন প্রণয়ন করা উচিত। এটা বিভিন্ন দপ্তরের পারঙ্গমতার (পারফরমেন্স) ধারাবাহিকতার স্বাক্ষর। এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা হয়ে থাকে। এর থেকেই সংশ্লিষ্টরা সরকারের চ্যালেঞ্জগুলো জানতে পারে।’
২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন ছিল ৫৫৫ পৃষ্ঠার। সেটি ছিল সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী সারসংক্ষেপ (এক্সিকিউটিভ সামারি)। তাতে সরকারের সামষ্টিক অর্থনীতি ও উন্নয়ন কর্মসূচির বিস্তারিত বিবরণ ছিল। অডিট আপত্তি, শৃঙ্খলা, বিভাগীয় মামলা, সরকারের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার কারণ, সরকারপ্রধানের বিদেশ সফর এবং মন্ত্রী ও সচিবদের ভ্রমণ-পরিদর্শন সম্পর্কিত প্রশাসনিক পদক্ষেপও ছিল। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির পর্যালোচনাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে। ডাকাতি, চুরি ছিনতাই. এসিড নিক্ষেপ, অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ব্যবহার, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের বছরভিত্তিক তথ্য ও আগের বছরের সঙ্গে এসব তথ্যের হ্রাস-বৃদ্ধির পরিসংখ্যানও ছিল। বিদ্যুতের সিস্টেম লসের গড় পরিসংখ্যান, বিদেশে জনশক্তি পাঠানোর হ্রাস-বৃদ্ধির কারণেরও উল্লেখ ছিল প্রতিবেদনে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিভিন্ন কর্মসূচিতে উপকারভোগীদের তথ্যও ছিল।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট বছরের ২২টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছিল। এগুলোর সমাধানের প্রসঙ্গও ছিল প্রতিবেদনে। অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল মৌসুমি রোগ ডেঙ্গুর নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক। বৈশ্বিক সংকটে মুদ্রানীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের চ্যালেঞ্জের উল্লেখও ছিল প্রতিবেদনে। প্রবাস আয় (রেমিট্যান্স) আহরণের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতি (রিজার্ভ) বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ায় নতুন শ্রমবাজার খোঁজার তাগিদ দেওয়া হয়। চাকরি নিয়ে যারা বিদেশ যাবেন তাদের কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করার চ্যালেঞ্জিং কর্মসূচি নেওয়ার তাগিদও ছিল প্রতিবেদনে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর নানা কর্মসূচিতে একই উপকারভোগীর বারবার সুবিধা নেওয়া বন্ধ করার বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ ত্রুটি দূর করার জন্য অনলাইন ডাটাবেজ তৈরির সিদ্ধান্ত হয় বার্ষিক প্রতিবেদনের পর্যালোচনা বৈঠকে। দেশের যত্রতত্র ঘরবাড়ি করা হচ্ছে, এতে নষ্ট হচ্ছে কৃষিজমি। শুধু ঘরবাড়ি নির্মাণই নয় বিভিন্ন সরকারি অফিস, রাস্তা নির্মাণ করতেও কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। কৃষিজমির সুরক্ষা সরকারের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং বিষয় বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে ওই বছর সমাপ্ত প্রকল্পের তালিকা ছিল।
২০২২-২৩ অর্থবছরে মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ও তাদের লোকসানের পরিমাণ উল্লেখ ছিল প্রতিবেদনে। ওই বছর সরকারের ৩৫টি প্রতিষ্ঠান ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা লোকসান দেয়। লোকসানি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিভিন্ন গ্যাস কোম্পানি, পাট কল, বিভিন্ন চিনিকল লোকসানি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে ছিল। ৫৮টি প্রতিষ্ঠান ২০ হাজার ২৬২ কোটি টাকা মুনাফা করে বলেও উল্লেখ করা ছিল প্রতিবেদনে। বিভিন্ন বিভাগের অডিট রিপোর্টের গুরুতর অনিয়মের কিছু তথ্যও ছিল। রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ক্যাশিয়ারের সাত কোটি টাকা আত্মসাৎ করার ঘটনাটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ১৪০ কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্যও ছিল। বেসিক ব্যাংকের আর্থিক অনিয়মের কথারও উল্লেখ ছিল। অনিয়মের অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে আবার আর্থিক লেনদেনসংক্রান্ত কাজে নিয়োগ করার ফলে নতুন করে তার অনিয়মের বিস্তারিত বর্ণনা ছিল ওই প্রতিবেদনে।
একজন সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শুধু মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের পরেই বার্ষিক প্রতিবেদনের বিশ্লেষণ হয় তা নয়। বার্ষিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উদ্যোগে একাধিক সচিবসভা হয়। সেসব সভায়ও সরকারের সামগ্রিক বিষয়গুলো জানা যায়। স্বাভাবিক নিয়মে একজন সচিব শুধু তার মন্ত্রণালয়ের বিষয়গুলোই জানবেন। কিন্তু এ ধরণের পর্যালোচনা সভায় সব মন্ত্রণালয়ের সমস্যা, সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি সম্পর্কেও অবগত হওয়া যায়। এতে সরকারের সিদ্ধান্তগ্রহণ যথাযথ হয়।’
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বার্ষিক প্রতিবেদনে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে তার উল্লেখ থাকে। অর্থাৎ অবধারিতভাবেই এ প্রতিবেদনে আগের সরকার অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের সিদ্ধান্তগুলোর বর্ণনা থাকবে। প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সচিবদের প্রচুর ছবি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ কারণে প্রতিবেদনটি প্রকাশের ব্যাপারে বর্তমান সরকারের অনীহা রয়েছে বলে ধারণা।