শুক্রবার   ০২ মে ২০২৫   বৈশাখ ১৮ ১৪৩২   ০৪ জ্বিলকদ ১৪৪৬

ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেফতারের পরোয়ানা

আজকাল রিপোর্ট -

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৩:৩৯ এএম, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ শনিবার

  • গাজা হত্যাযজ্ঞে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ 
  • ফ্রান্স আদালতের নির্দেশ মানবে


 
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে হেগের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। প্যালেস্টাইনের গাজায় হত্যাযজ্ঞে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারের ওয়ারেন্ট ইস্যু জারি করা হয়েছে গতকাল বৃস্পতিবার। এই আদালতের সদস্য এমন কোন রাষ্ট্রে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু  সফর করতে গেলে সেখানে তাকে গ্রেফতার করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ কারণে তাঁর বিদেশ ভ্রমণ সীমিত হয়ে আসবে। যুক্তরাষ্ট্র এই আদালতের সদস্য রাষ্ট্র না হবার কারণে আইসিসি’র ওয়ারেন্টের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ইউরোপের ২৭টি দেশের কোথাও নেতানিয়াহু সফরে গেলে তাঁকে গ্রেফতারের পক্ষে মত দিয়েছে তারা। ফ্রান্স আদালতের নির্দেশ পালন করবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে।
আদালত একই সঙ্গে ইসরাইলি সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টকেও গ্রেফতারের ওয়ারেন্ট জারি করেছে। একই আদালত হামাস নেতা মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে গ্রেফতারের পরোয়ানা জারি করে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর দাবি, গত জুলাই মাসে গাজায় একটি বিমান হামলায় মোহাম্মদ দেইফ নিহত হয়েছেন। বিচারকগণ বলেছেন, ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ওই তিন ব্যক্তিকে অপরাধের জন্য দায়ী করার ‘যুক্তিসঙ্গত কারণ’ আছে। গতকাল আইসিসি পরোয়ানা জারি করার পর যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার মিডিয়া নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, নিউইয়র্ক পোস্ট, সিএনএন, ওয়াশিংটন পোস্টসহ সব মিডিয়ায় প্রধান শিরোনাম ছিল ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে ঘিরে।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, তার প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে গাজায় ১৩ মাসের যুদ্ধ চালিয়ে হত্যা, খাবার সরবরাহে বাধা সম্পর্কিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে বিশ্বের শীর্ষ এই ‘ওয়ার ক্রাইম কোর্ট’।
আদালতের  তিন বিচারপতির প্যানেল সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করে। প্যানেলটি বলেছে যে, তাদের বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি রয়েছে যে তারা ‘ইচ্ছাকৃতভাবে এবং জেনেশুনে গাজার বেসামরিক জনগণকে বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য বস্তু থেকে বঞ্চিত করেছে। যার মধ্যে রয়েছে খাদ্য, পানি, ওষুধ, জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ। বিচারপতিরা আদালতের এখতিয়ারকে চ্যালেঞ্জ করে একটি ইসরায়েলি আবেদনও প্রত্যাখ্যান করেছেন এই ভিত্তিতে যে ইসরায়েল ট্রাইব্যুনালের সদস্য রাষ্ট্র নয়।
জারি করা পরোয়ানায় বলা হয়েছে, নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট মানবিক সহায়তা সীমাবদ্ধ করে ‘অনাহারকে যুদ্ধের পদ্ধতি হিসাবে’ ব্যবহার করেছেন এবং গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অভিযানে ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করেছেন বলে বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে। এ অভিযোগ ইসরায়েলি কর্মকর্তারা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মতে, গাজায় ইসরায়েলের অভিযানে মৃতের সংখ্যা ৪৪,০০০ ছাড়িয়ে যাওয়ার পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এই পদক্ষেপ নিয়েছে। নিহতদের অর্ধেকেরও বেশি মহিলা ও শিশু ছিল। তাদের সংখ্যা বেসামরিক এবং যোদ্ধাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজা জুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ইসরায়েলি সৈন্যদের দ্বারা অবরুদ্ধ অঞ্চলটির উত্তরে দুর্ভিক্ষের মাত্রায় পৌঁছেছে।
এদিকে নেতানিয়াহু তাঁর বিরুদ্ধে জারি করা পরোয়ানার নিন্দা করে বলেন, ইসরায়েল আদালতের ‘অযৌক্তিক ও মিথ্যা পদক্ষেপকে ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে’। তাঁর কার্যালয় থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘গাজায় ইসরায়েল যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তার চেয়ে ন্যায্য আর কিছু নেই।’
আদালতের এই সিদ্ধান্তে নেতানিয়াহু এবং অন্যদেরকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। তাদের বিদেশ ভ্রমণের সময় গ্রেফতারের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। তবে এর ব্যবহারিক প্রভাব সীমিত হতে পারে। কারণ ইসরায়েল এবং তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র  এই আদালতের সদস্য  রাষ্ট্র নয়।
ইসরাইলি নেতা, রাজনীতিবিদ এবং কর্মকর্তারা এই পরোয়ানা এবং আইসিসি’র নিন্দা করেছেন। নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ, যিনি এই মাসের শুরুতে গ্যালান্টের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, আদালতের ‘একটি নৈতিক অসম্মান, সম্পূর্ণরূপে ইহুদি বিদ্বেষ দ্বারা কলঙ্কিত, এবং আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থাকে অভূতপূর্ব নি¤œ স্তরে নিয়ে গেছে’। তবে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি এই পদক্ষেপের প্রশংসা করে বিবৃতি দিয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সহযোগী আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার পরিচালক বালকিস জারাহ এক বিবৃতিতে বলেন, উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে এই পরোয়ানা এই ধারণাটি ভেঙে দিয়েছে যে কিছু ব্যক্তি আইনের নাগালের বাইরে। আইসিসি’র প্রধান প্রসিকিউটর করিম খান পরোয়ানা জারির অনুরোধ জানানোর ছয় মাস পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।
২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর গাজায় ইসরাইলের আক্রমণের সূত্রপাতকারী হামাসের সশস্ত্র শাখার প্রধান মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে আদালত একটি পরোয়ানা জারি করে। এতে বলা হয়েছে যে দেফ হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন এবং যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি পাওয়া গেছে। দক্ষিণ ইসরাইলে হামলা চালিয়ে ১,২০০ জনকে হত্যা করে-বেশিরভাগই বেসামরিক-এবং প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে। গাজায় প্রায় ১০০ জন ইসরাইলি বন্দী রয়েছে, তাদের মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ মারা গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। পরোয়ানা সত্ত্বেও, সন্দেহভাজনদের কাউকেই খুব শীঘ্রই হেগের বিচারকদের মুখোমুখি হতে হবে না।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেন, এই গ্রেফতারি পরোয়ানা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি সদস্য দেশের জন্য বাধ্যতামূলক। ফ্রান্স ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করতে পারে।