সোমবার   ২০ মে ২০২৪   জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১   ১২ জ্বিলকদ ১৪৪৫

ঢাবি থেকে অ্যামাজনের ডেটা অ্যানালিস্ট শেখ আব্দুল্লাহ

নিউজ ডেস্ক

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:২৬ পিএম, ৮ এপ্রিল ২০২৪ সোমবার

দেশ সেরা বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি জমিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার ওহিও অঙ্গরাজ্যের রাইট স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে বিজনেস অ্যানালিটিকস অ্যান্ড ইনসাইটে করেছেন মাস্টার্স। তারপর যোগ দিলেন বিশ্বের বিখ্যাত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম অ্যামাজনের ডেটা অ্যানালিস্ট হিসেবে। এই সফলতার পুরো গল্প শুনিয়েছেন ইত্তেফাক ডিজিটালকে।

২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগে ভর্তি হন ফরিদপুরের ছেলে শেখ আব্দুল্লাহ। এখান থেকেই সম্পন্ন করেছেন বিবিএ ও এমবিএ। ছয় ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি।

গ্রামের অস্বচ্ছল কৃষক পরিবারে জন্ম আব্দুল্লাহর। কিন্তু দরিদ্র তার স্বপ্ন পূরণে কোনো বাঁধা হয়েই দাঁড়াতে পারেনি। তিনি বলেন, যখন থেকে শারিরীক সক্ষমতা হলো তখন থেকেই আমি অন্যের জমিতে কাজ করেছি, নিজেদের যতটুকু ছিলো সেটাও বাবার সঙ্গে আবাদ করেছি। পড়াশোনার জন্য বাবা সবসময়ই উৎসাহ দিতেন তবে অসচ্ছলতাই বারবার পিছু টানতো।

শৈশবে ক্রিকেট ছিল আব্দুল্লাহর নেশা। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া পর্যন্ত দুপুর অব্দি অন্যের জমিতে কাজ করে বিকালে বের হতেন প্রিয় ক্রিকেট ব্যাট হাতে। তাই খুব বেশি নিয়মিত ক্লাস করতে পারতেন না। তবে অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকেই টিউশন করানো শুরু করেন তিনি। পাশাপাশি জমিতে কাজ করাও কমিয়ে দেন।

নবম শ্রেণিতে ইচ্ছা ছিল বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হবেন। কিন্তু নিজ স্কুলে বিজ্ঞান শাখা না থাকায় ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারেননি।

আব্দুল্লাহ বলেন, মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রি-টেস্টে ভালো ফল করার পর প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক আমার বাবার কাছে আসেন আর আমাকে আগামি তিন মাস কাজ না দেওয়ার অনুরোধ করেন। বাবা তাতে রাজি হন। ঢাকা থেকে কুরিয়ারে আমার জন্য নোটবুকের ব্যবস্থা করা হয়। আর তখন থেকেই আমার পড়াশোনা শুরু হয়। আর মাধ্যমিকে জিপিএ ৫ পাওয়ার পর এলাকায় আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে গোল্ডেন আব্দুল্লাহ নামে।

অদম্য মেধাবী হলেও প্রতিবন্ধকতা ছিল পারিবারিক অস্বচ্ছলতা আর অভাব, অনটন। যার কারণে বড় স্বপ্নও দেখা হয়নি শুরুতে। তখনকার সময়ে আব্দুল্লাহর সাফল্য নিয়ে কয়েকটি খবরের কাজে সংবাদ প্রকাশ হয়।

তবে আজকে আব্দুল্লাহ হয়ে উঠার পেছনে অবদান রেখেছেন তার ফুফাতো ভাই বকুল। আব্দুল্লাহর বাবা ৩০ শতক চাষের জমি বন্ধক রেখে ঢাকায় পড়াশোনা করাতে একসময় রাজি হন। ঢাকা কমার্স কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর আব্দুল কাইউয়ুমের সঙ্গে কথা বলে বকুল তাকে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার ব্যবস্থা করে দেন। কলেজ থেকে পেয়েছেন সর্বোচ্চ সহায়তা।

তারপর উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশসেরা বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান। কিন্তু তখন ফের বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভর্তি ফি। কষ্ট করে অবশ্য সেটি যোগাড় করে ফেলেন। বিষয় পছন্দ করার সময় তার অপশন ছিল ট্যুরিজম, ম্যানেজমেন্ট আর ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস (আইবি)। ভবিষ্যত আর আন্তর্জাতিক চাকরির বাজারের কথা মাথায় রেখে আইবিকে বেছে নেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে জড়িত ছিলেন সক্রিয় ছাত্ররাজনীতিতে। রাজনীতি, পড়াশোনা আর কোচিংয়ে ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি সাফল্যের সঙ্গে বিবিএ, এমবিএ সমাপ্ত করেন তিনি।

২০২০ সালের পর ছাত্র রাজনীতিতে হতাশ হয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য কানাডায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন শেখ আব্দুল্লাহ। কিন্তু কানাডার উচ্চ টিউশন ফির কারণে এই স্বপ্ন থেকে সরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন ২০২১ সালের দিকে। তখন থেকেই সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের মতো করে প্রস্তুতি নিতে থাকেন।

আব্দুল্লাহ বলেন, প্রথমে আমি ফুল ফান্ড পাইনি। কারণ গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টারে ইউনিভার্সিটিতে খুব কমই ফান্ড থাকে। আর আমি ২০২২ সালের গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টারের জন্যই আবেদন করি। ওই বছরের ১৭ এপ্রিল আমার ভিসা হয়। ৫৫ শতাংশ স্কলারশিপ পেয়েছিলাম আমি। আর এখানে আসার পর ফুল ফান্ড পেয়ে যাই।

যুক্তরাষ্ট্রে কর্মজীবন সম্পর্কে আব্দুল্লাহ বলেন, প্রথম ইন্টার্নশিপ পাই ডিলার্ড’স নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। ওরা আমাকে ফুল টাইম অফার করলেও আমি সেটা নেইনি। এরপর ২০২৩ সালের মে মাসে অ্যামাজনে জয়েন করি। মজার ব্যাপার হলো অ্যামাজনে কারো জন্য সুপারিশ করা যায় না। আপনার জন্য যদি কেউ সুপারিশ করে তাহলে ধরে নেওয়া হয় আপনি অযোগ্য বা কম যোগ্যতাসম্পন্ন।

তিনি বলেন, নয় মাস অ্যামাজনে এইচআর অ্যাসোসিয়েট পার্টনার হিসেবে কাজ করি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার ডিগ্রি শেষ হয়। এর মাধ্যমে বেশ কিছু টুলস শিখতে সক্ষম হই। এর মধ্যে এক্সেল, পাইথন, ট্যাবলো, এসকিউএল অন্যতম। ডাটা অ্যানালিস্ট হিসেবে চাকরি করতে চাইলে টুলসগুলো জানা থাকা খুবই জরুরি। এরপর আমি ডিসেম্বর থেকেই ডাটা এনালিস্ট পজিশনের জন্য এপ্লাই করতে থাকি।

গত ২৯ মার্চ তিনি ইন্টারভিউয়ের ফল জানতে পারেন। আর অ্যামাজন থেকে তার হাতে অফার লেটার আসে গত ৪ এপ্রিল।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে আব্দুল্লাহ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইচ্ছা নেই যদিও অ্যামাজনই গ্রীনকার্ডের ব্যবস্থা করবে। তবে ব্যবসা করার ইচ্ছা আছে। আমেরিকায় ব্যবসার বিকল্প নেই। কয়েকজনকে নিয়ে আইটি ফার্ম করার ইচ্ছা আছে। আর সেই ফার্মে বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েদের ইন্টার্ন এর ব্যবস্থা রাখব।

তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর কিছু সংখ্যক মেধাবীদের এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করার লক্ষ্যে বাবা মায়ের নামে একটা ফাউন্ডেশন খুলবো। এর কাজ ইতিমধ্যে শুরু করেছি ‘লোকমান জোছনা মেধাবী কল্যাণ তহবিল’ নামে। বাবা-মায়েরও আমেরিকার ভিসা হয়েছে গত সপ্তাহে। এখন তো চাইলেই বাবামাকেও দেখতে পারবো।