সোমবার   ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আশ্বিন ৭ ১৪৩২   ২৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

বিএনপি’র রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে তোলপাড় ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে -

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৩:০৫ এএম, ৩০ মার্চ ২০২৪ শনিবার



বিএনপি ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেয়ায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। দলটির যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র রিজভী আহমেদ সম্প্রতি একটি সমাবেশে নিজের গায়ে থাকা ভারতীয় চাদর মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে পণ্য বর্জনের আহ্বান জানান। তার পরপরই ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা জরুরী ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাদের আলোচনায় ভারতীয় পণ্য বর্জনের জন্যে বিএনপি’র আহ্বানের বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করেছে। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় কাজে বিএনপি’র এক সমাবেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের রাজনীতির কড়া সমালোচনা করেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপি নেতারা তাদের বউদেরকে ভারতীয় শাড়ি পরা বন্ধ করুক। তারা ভারতীয় পেঁয়াজ, রসুন, আদা খাওয়া বন্ধ করুক। তারপর ভারতীয় পণ্য বর্জন করার কথা বলুক’।
বিএনপি গত নির্বাচনসহ কয়েকটি নির্বাচনে ক্ষমতায় না যাওয়ার জন্যে ভারতকে দায়ী করে থাকে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো বারবার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলো। কিন্তু ভারত ওই সময়ে ঘোষণা করে যে, তারা বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে। নির্বাচনের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সবার আগে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। বিএনপি’র কোনও কোনও নেতা মনে করেন, ভারতীয় পণ্য বর্জনে দলের কোনও সম্মতি নেই। এই ঘোষণা রিজভী আহমেদের নিজের ব্যক্তিগত ঘোষণা। দলের সিদ্ধান্ত নয়। কিন্তু এতবড় একটা ঘোষণা ব্যক্তিগতভাবে দেবার পর বিএনপি তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না এটা অবিশ^াস্য। শুধু বিএনপি নয়, সমমনা দলগুলোও একই ধরনের ঘোষণা দিয়েছে।
সরকারের তরফে বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের বাজারকে অস্থিতিশীল করতে একটি চক্রান্তের অংশ হলো এই ভারতীয় পণ বর্জন। তবে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক যারা দিয়েছেন তারা মনে করেন, ভারতের ওপর এটা একটা চাপের সৃষ্টি হবে। এতে করে ভারত তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টাতে পারে। তবে বিএনপি’র কোনও কোনও নেতারা মনে করেন, এটা হিতে বিপরীত হতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন, বিএনপি’র অভ্যন্তরে থাকা কট্টর পাকিস্তানপন্থী অংশের পরামর্শের ফলে এই ঘটনা ঘটেছে।    
ঈদকে সামনে রেখে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিপণী বিতানে ভারতীয় পণ্যে সয়লাব। হাল ফ্যাশনের সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি, লেহেঙ্গাসহ হরেক রকমের সামগ্রী বিক্রিও হচ্ছে। ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় ভারতীয় পণ্যের এতটাই কদর। এছাড়াও, ভারতের পেঁয়াজ, আদা এমনকি শাকসব্জি পর্যন্ত হরদম বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের বাজার বিস্তৃত। চার হাজার কিলোমিটারের বেশি স্থল সীমান্ত এবং নৌ ও আকাশ পথে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ নিবিড়। প্রতিবেশি হওয়ায় পরিবহন খরচ কম। ফলে দামেও সস্তা। এসব কারণে সাধারণত বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধী মনোভাব থাকলেও ভারতীয় পণ্য ব্যবহারে কোনও বাছ-বিচার নেই। নানা কারণে ভারতকে যারা ঘৃণা করে, তারাও ভারতীয় পণ্য নিয়ে থাকে। ফলে রিজভীর ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক হালে পানি পায়নি।
বিএনপি’র রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতা নতুন নয়। বিএনপি’র চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভারতবিরোধী বক্তৃতা দিয়ে গোটা নব্বই দশকে উত্তাপ ছড়িয়ে ছিলেন। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি সই হলে খালেদা জিয়া চুক্তির বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি এই চুক্তির বিরুদ্ধে ঢাকা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত লং মার্চ করেন। ওই সময়ে খালেদা জিয়া বলেছেন, শান্তি চুক্তির কারণে বাংলাদেশের এক-দশমাংস ভূমি ভারতে চলে যাবে। চুক্তির মাধ্যমে ভারতের কাছে বাংলাদেশ বিক্রি করে দিয়েছে। ইত্যাদি নানা ধরনের চুক্তি বিরোধী মন্তব্য তখন জমে ছিল।
বিএনপি’র ভারত বিরোধিতার সবচেয়ে বড় দৃশ্যমান ঘটনা ছিল ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরকালে হরতাল দেয়া। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের অনুরোধ উপেক্ষা করে ওই হরতাল ডাকা হয়েছিল। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান ধরা পড়ে। এসব অস্ত্র ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর কাছে যাচ্ছিল বলে খবর বের হয়েছিল। এ ধরনের নানা কারণে ভারতের সঙ্গে বিএনপি’র দূরত্ব সৃষ্টি হয়। শেখ হাসিনা তার উল্টোটা করেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা দমনের ব্যাপারে ভারতকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এতে করে শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়। ফলে ভারতের যে কোনও সরকারই শেখ হাসিনাকে সমর্থন করে থাকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহায়তা করেছিল।     
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সমর্থন করলেও কিছু কিছু ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ লেগেই আছে। তার অন্যতম হলো, সীমান্তে হত্যাকান্ড এবং তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা না দেওয়া। এসব কারণে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত বিরোধী মনোভাব ক্রমেই বাড়তে থাকে। এসত্ত্বেও বাংলাদেশে ভারতের পণ্যের চাহিদা রয়েছে। শুধু পণ্যই নয়; প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ পর্যটন, চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি কাজে ভারত সফর করেন। প্রতি বছর ভারত প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশীকে ভিসা দিয়ে থাকে। তবে ভারতীয় ভিসা পেতে হয়রানি কিংবা নানা অজুহাতে ভিসা প্রত্যাখ্যান করার কারণেও মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধিতার জন্ম হয়। এছাড়াও, ভারতের নেতৃবৃন্দের মধ্যে ‘বড়ভাই’ সুলভ আচরণ ভারত বিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি করেছে। ভারতে সংখ্যালঘূ মুসলমানদের ওপর দমন-পীড়নও বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। বিশেষ করে নাগরিকত্ব আইনসহ বিজেপি সরকারের কিছু কিছু বৈষম্যমূলক আইন বাংলাদেশে প্রভাব ফেলেছে। এসব কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে ব্যাপক সহিংস ঘটনার সৃষ্টি হয়েছিল।