বিদায় নিচ্ছেন পিটার হাস!
বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা থেকে
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৩:৪৬ এএম, ২ মার্চ ২০২৪ শনিবার

বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে দেখতে চায় বাইডেন প্রশাসন
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস কি বিদায় নিচ্ছেন। মার্কিন প্রতিনিধি দলের সফরের পর এ গুঞ্জন ডালপালা মেলেছে। এদিকে, প্রতিনিধি দলের সফরের পর এটা প্রায় নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে দেখতে চায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন। প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহ দেখাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেনের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির এজেন্ডা বাস্তবায়নে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন করে সাজানোর এই উদ্যোগ বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে বেশ টানাপোড়েন দেখা দিয়েছিল। এখন সেই ক্ষত সারানোর চেষ্টার অংশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছে। নতুন ধরনের সম্পর্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে ওয়াশিংটনের আগ্রহের বার্তাও ঢাকার কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এই সফরের ধারাবাহিকতায় শিগগিরই বাংলাদেশ সফরে আসছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদেরও যুক্তরাষ্ট্র সফরের সম্ভাবনা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের আইলিন লাউবুচার, পররাষ্ট্র দফতরের আফরিন আক্তার, মার্কিন সহায্য সংস্থা ইউএসএআইডি’র মাইকেল শিফারের সমন্বয়ে গঠিত এই প্রতিনিধি দলটি গত ২৪ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বাংলাদেশ সফর করেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রতিনিধি দলের এটি প্রথম সফর। কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন করে ঢেলে সাজানোর ইতিবাচক বার্তা পৌঁছানো সফরের মূল কথা। গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল বাইডেন প্রশাসন। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে একের পর এক প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফর বাংলাদেশ সরকারকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলেছিল। ওই সময়ে বিভিন্ন প্রতিনিধি দলের ঢাকায় আগমন করে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বাস্তবায়নে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করলে পরিবারবর্গসহ ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেখার কথা বলা হয়েছিল।
নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও প্রায় ৪২ শতাংশ ভোট পড়েছে। যদিও ভোটের পর পরই দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে ‘নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি’ বলে মন্তব্য করা হয়েছিল। কিন্তু একই বিবৃতিতে শেখ হাসিনার নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপানসহ বিশে^র অধিকাংশ দেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতি দিলেও যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিক কোনও অভিনন্দন জানায়নি। ফলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে একত্রে কাজ করার ক্ষেত্রে খানিকটা অস্বস্তি ছিল। এই অবস্থার অবসানের লক্ষ্যে ভোটের এক মাস পর ৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি চিঠি পাঠান প্রেসিডেন্ট বাইডেন। চিঠিতে নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিক বিষয়ে বাংলাদেশের কাছে স্পর্শকাতর কোনও প্রসঙ্গই তোলেননি। বরং বাংলাদেশে নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। বাইডেনের নামে পাঠানো চিঠিতে অবশ্য বাইডেনের নিজের সই ছিল না। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে নিজের হাতে সই না করার পরামর্শ দিয়েছে বলে মনে করা হয়।
বাইডেন প্রশাসন দুই ভাবে সম্পর্কের কিছুটার ঘাটতির ইঙ্গিত দিয়েছে। শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন জানাননি। এছাড়াও, শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো চিঠিতে নিজ হাতে সই করেননি। বাকি সবই ইতিবাচক সম্পৃক্ত থাকার কথা বলা হয়েছে। বাইডেনের চিঠি দুই দেশের সম্পর্ক নতুন করে শুরু করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। নির্বাচনের আগের শেখ হাসিনার সরকারকে বেকায়দায় ফেলানোর মার্কিন নীতির নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকায় অবস্থিত দূতাবাসকে দায়ী করা হয়। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নিখোঁজ বিএনপি নেতার বাড়ি যাওয়া, বিএনপি অফিসে তথাকথিত বাইডেনের উপদেষ্টার উপস্থিতি, বিএনপি’র এক নেতার পিটার হাসকে অবতার হিসাবে উল্লেখসহ নানা ঘটনায় আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে স্পষ্ট হয় যে, পিটার হাস নিরপেক্ষ নন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগে যখন ক্ষোভের আগুন, তখন পিটার হাস অভিযোগ করেন যে, তিনি নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি হুমকি টের পাচ্ছেন। এছাড়াও, ওয়াশিংটনে তিনি যে বার্তা পাঠিয়েছেন তাতে তার বিশ্লেষণ যে ভুল ছিল সেটা প্রমাণ হয়েছে। বিএনপি আন্দোলন করে সরকার পতন ঘটাতে পারবে না এমন তথ্য সম্ভবত তিনি পাঠাতে পারেননি। এসব কিছুই সম্পর্ককে তিক্ত করে তোলে। ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক এতটাই খারাপ হয়েছিল যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করেন যে, বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। শেখ হাসিনার সরকারের ওপর মার্কিন চাপে নাখোশ ভারত।
ওয়াশিংটন বিষয়টি আঁচ করতে পেরে পিটার হাসকে বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পদ থেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে বলে নির্ভরযোগ্য কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। মার্কিন প্রতিনিধি দলের এবারের সফরকালে সরকারের সঙ্গে কোনও বৈঠকে পিটার হাসকে রাখা হয়নি। বরং অস্বস্তি এড়াতে প্রতিনিধি দলের সফর চলাকালে ছুটি নিয়ে সিঙ্গাপুর চলে যান। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের অন্যান্য পর্যায়েও কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে।
নির্বাচনের আগে ও পরে শেখ হাসিনার সরকারের অনেককে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হতে দেখা গেছে। বাইডেন প্রশাসনের কাছে এটা স্পষ্ট যে, বর্তমান সরকার আগামী তিন বছর বিনা বাধায় দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে। বাংলাদেশে যে কোনও সরকারের মেয়াদের শেষের দুই বছরে রাজপথে আন্দোলন হয়। শেখ হাসিনার সরকারের তরফে কূটনৈতিক চ্যানেলে বাইডেনের প্রশাসনকে জানানো হয় যে, রাশিয়া, চীন, ভারতসহ কোনও দেশই এতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগ পায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের কারণে ওই সকল দেশও এখন কথা বলতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কোনও উদ্বেগ থাকলে যেন গোপনে বাংলাদেশ সরকারকে জানায়।
বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে ভূ-রাজনৈতিক ফ্যাক্টরকে অন্যতম কারণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র উপযুক্ত মিত্র খুঁজছে। কারণ ভারত যদিও মার্কিন মিত্র কিন্তু দিল্লি সর্বদা একান্ত অনুগত নয়। মালদ্বীপে চীনপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নেপালের মাওবাদি নেতা পুস্পকমল প্রচন্ডও চীন ঘেঁষা। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় ঘটেছে। ফলে বাংলাদেশ হতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র। মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে থেকে যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকা পালন করতে পারে। তাছাড়া, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি মধ্যপ্রাচ্যের দিকে অধিক মনযোগ দিয়েছে। অন্য কোনও দিকে মনযোগ দেবার ইচ্ছা এই মূহূর্তে বাইডেন প্রশাসনের নেই। আবার বাইডেনের সামনে নির্বাচন। নির্বাচনের আগে নতুন নতুন ফ্রন্ট খোলাও তার জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ। এমন একটা ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠদের মতে, মিয়ানমার পরিস্থিতি সামনের দিনে যেভাবে খারাপ হচ্ছে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার আরও সুযোগ পাবে শেখ হাসিনার সরকার। শেখ হাসিনা সম্প্রতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলনস্কির সঙ্গে বৈঠক করার মাধ্যমে তাকে পুঁজি করে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করছে।
বাইডেনের চিঠিতে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন, মানবিক ইস্যু প্রভৃতি ক্ষেত্রে সম্পর্ক জোরদারের কাজ চলছে। যুক্তরাষ্ট্র ডিএফসি নামের একটি তহবিল থেকে বাংলাদেশকে আর্থিক সহায়তা দেবার প্রস্তাব করেছে। ওয়াশিংটন এটাও চাইছে যে, বাংলাদেশ যেন জিসোমিয়া নামের সামরিক চুক্তি সই করে। এই চুক্তির মাধ্যমে স্পর্শকাতর গোয়েন্দা তথ্যেও আদান-প্রদানই শুধু নয়; বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির পথও সুগম হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র তার মূল্যবোধভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি থেকে একবারে সরে যায়নি। বরং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টাও চালিয়ে যাবে। মার্কিন প্রতিনিধি দল বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বিরোধী নেতা-কর্মীদের কারাগারে আটক থাকার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে। সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও বৈঠক করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত করা নিয়ে আলোচনা করেছে। বাংলাদেশও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা মোতাবেক পুরোপুরি মার্কিন বলয়ে যোগ দেবে না। বরং ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অব্যাহত রাখবে।