মঙ্গলবার   ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আশ্বিন ৮ ১৪৩২   ৩০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

বাংলাদেশের চারপাশে আঞ্চলিক অস্থিরতার উত্তাপ

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৩:১৩ এএম, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ শনিবার

সাউথ চায়না সি, গাজা ও ইউক্রন যুদ্ধ : এবার নতুন হটস্পট বঙ্গোপসাগর!

 

উত্তেজনায় টগবগ করছে বাংলাদেশের আশপাশ। হটস্পট মিয়ানমার। আরেকটু বড় ক্যানভাসে বিষয়টা দাঁড়ায়, বঙ্গোপসাগর ঘিরে আধিপত্যের লড়াই। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তা ডোনাল্ড লু বললেন, বিস্তৃতি আরও বেশি। ভারত মহাসাগর। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত জলরাশি কতটা উত্তাল হতে পারে তার আভাস মিলেছে।
ডোনাল্ড লু নতুন সুরে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়কে তাদের সমুদ্রনীতির পার্টনার হিসাবে অভিহিত করেছেন। সম্প্রতি পেন্টাগণ, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ, পররাষ্ট্র দফতরের উচ্চ পর্যায়ের প্যানেল আলোচনায় ভারত মহাসাগর ঘিরে ওয়াশিংটনের নীতির আলোকপাত করেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির দুই বছরপূর্তি উপলক্ষে এই প্যানেল আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল। ওয়াশিংটন ভিত্তিক দ্য ইউএস ইন্সস্টিটিউট অব পিস নামের একটি থিঙ্কট্যাঙ্ক এই আলোচনার আয়োজন করে। বাইডেনের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির প্রয়োগ বাংলাদেশ ও তার আশেপাশে জোরদার হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্যে বিষয়টা যথেষ্ট দুশ্চিন্তার জন্ম দিতে পারে। সাউথ চায়না সি, গাজায় ইসরাইলি হামলা ঘিরে মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেনে যুদ্ধের পর বাংলাদেশ ও তার আশেপাশে নতুন হটস্পট হলে তা শুধু উদ্বেগ বাড়াবে।
যুক্তরাষ্ট্রের আলোচিত কূটনীতিক ডোনাল্ড লু দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী। পাকিস্তানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী একদা কিংবদন্তী ক্রিকেটার ইমরান খান প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হলে তিনি এই ঘটনার জন্য ডোনাল্ড লুকে দায়ী করেন। বাংলাদেশেও বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বেশ সক্রিয় ছিলেন। ভোটের পরে শেখ হাসিনাকে মেনে নিয়েছেন। কৌশলগত দিকনির্দেশনায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সামনে লু তার ভাষণে শ্রীলঙ্কার প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির সহায়তায় শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এই কৌশল বাস্তবায়নে সেখানে সহায়ক ছিল ভারত। এবার দিল্লি ও ঢাকাকে সতর্ক করে লু বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকটের বাইরেও মিয়ানমারে যে অস্থিরতা চলমান, তার প্রভাব প্রতিবেশির ওপর পড়তে পারে।
ডোনাল্ড লু সম্প্রতি মালদ্বীপ সফর করেছেন। মালদ্বীপে সাম্প্রতিক নির্বাচনে চীনপন্থী সরকার গঠিত হলে ওয়াশিংটনকে তা নাড়া দিয়ে যায়। তিনি বলেছেন, চীন যদি অপরাপর দেশের সঙ্গে সত্যিকার প্রতিযোগিতা করে তবে সেটা ভাল। তবে তিনি এটা স্বীকার করেছেন যে, ভারত মহাসাগরের ওপর ভারতের নেতৃত্ব রয়েছে। ফলে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত আফ্রিকার সমুদ্র উপকূলের দেশসমূহ নিয়ে আলোচনা করবে।
কেউ কেউ মনে করেন, বিশে^র দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের সঙ্গে এশিয়ায় প্রতিযোগিতা নেমে বাইডেন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি তৈরি করেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আগেই ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) করে এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকায় ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, সংস্কৃতির বলয় সৃষ্টির প্রয়াস নিয়েছেন। শ্রীলঙ্কায় অস্থিরতার জন্যে চীনের ঋণের ফাঁদকে কেউ কেউ দায়ী করলেও ডোনাল্ড লু বলেন, বিশৃঙ্খলা থেকে শ্রীলঙ্কার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটা ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির কৃতিত্ব। তিনি বলেন, দেড় বছর আগে শ্রীলঙ্কায় যে সংকট হয়েছে তাতে তখন রাস্তায় দাঙ্গা হয়েছে। পেট্রোল ও খাদ্যের জন্যে মানুষ লাইন দিয়েছে। প্রেসিডেন্টের বাসভবন পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল জনতা। প্রেসিডেন্টের সুইমিং পুলে জনগণ সাঁতার কেটেছে। কিন্তু এখন শ্রীলঙ্কায় গেলে দেখতে পাবেন, আজকের শ্রীলঙ্কা ভিন্ন এক জায়গা। বর্তমানে দেশটি স্থিতিশীল। পণ্য ও জ¦ালানীর মূল্য স্থিতিশীল। তারা ঋণের কাঠামোয় পরিবর্তনের আশ^াস পেয়েছে। আইএমএফের অর্থের প্রবাহও রয়েছে।
এটা কীভাবে ঘটলো? মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক কর্মকর্তা বলেন, বন্ধুদের সামান্য সহায়তায় এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি এবং সমমনা পার্টনাররা সহযোগিতা করেছে। শ্রীলঙ্কার কঠিন দিনগুলোতে ভারত ছাড়ের ঋণ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এর মাধ্যমে জরুরী সরবরাহ পাওয়া সম্ভব হয়েছে। একই সময়ে মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডি কৃষি, সার, বীজসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তার জন্যে শত শত মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। এতে করে কৃষক তার পণ্য উৎপাদন করেছে নিজের ফসল থেকে। জাপান, ফ্রান্স, ভারত নতুন কাঠামোয় ঋণ দিয়েছে। এই ফর্মুলার কারণে চীনকেও ঋণের নতুন আশ^াস দিতে বাধ্য করেছে। আইএমএফ তহবিল উন্মুক্ত হবার পর আজকের পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। কলম্বো বন্দরে গভীর পানির টার্মিনাল নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্রের ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন থেকে ৫৫৩ মিলিয়ন ডলার দেয়া হয়। এই প্রকল্পে মূল পার্টনার ভারতের আদানি গ্রুপ। যুক্তরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কাকে নিরাপত্তার জন্য পেট্রোল বোট দিয়েছে। নিরাপত্তার জন্যে অবাধে স্যাটেলাইট ডাটাও দেয়া হবে। ভারত ইন্দো-প্যাসিফিক ইনফরমেশন সেন্টার স্থাপন করেছে। এখান থেকে জলদস্যুর উৎপাত কমানো, মাদক পাচার এবং অবৈধ মাছ ধরা থেকে সুরক্ষা পাওয়া যাবে।
মিয়ানমারকে ঘিরে চ্যালেঞ্জ:
ডোনাল্ড লু বলেন, ভারত ও চীনের মধ্যে সমস্যা রয়েছে। ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত নিয়ে ভীষণ বৈরীতা কাজ করে। মিয়ানমার পরিস্থিতির প্রভাব সেখান থেকে প্রতিবেশির ওপর বর্তাতে পারে। লু বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে অনেক সময় ব্যয় করেছি। রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বার্মার পরিস্থিতি আঞ্চলিক প্রভাব অনুধাবন করেছি’। তিনি বলেন, ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ উদারতার পরিচয় দিয়েছে। আমি কক্সবাজারে বিশে^র সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের সুযোগ পেয়েছিলাম। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের জন্যে কাজ করছে।
লু বলেন, বার্মার পরিস্থিতি ভাল হচ্ছে না। রোহিঙ্গা সংকট এবং নিরাপত্তা সমস্যা বাংলাদেশের জন্যে উদ্বেগজনক। এটা ভারতের জন্যেও উদ্বেগের। সংকট আগামীতে আরও বেশি গভীর।
মালদ্বীপ এবং চীন:
ডোনাল্ড লু বলেন, মালদ্বীপে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব বিস্তারের লক্ষে প্রতিযোগিতা করছে। যুক্তরাষ্ট্র ভালভাবে সহায়ক হবে। চীন যদি সত্যিকার প্রতিযোগিতার লক্ষে কাজ করে তবে সেটাও ভাল। কিন্তু আমরা বছরের পর চীনের এমন ঋণ দেখেছি যা টেকসই নয়। মালদ্বীপকে এক দশমিক তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ রয়েছে। এটা দেশটির সরকারের বাজেটের চেয়েও বেশি। নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেন লু। তিনি বলেন, মালদ্বীপ হলো ১২০০ দ্বীপ নিয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্র। তার টেরিটোরিয়াল ওয়াটার আছে ৫৩ হাজার কিলোমিটার। ফলে এটার আকৃতি ফ্রান্সের সমান। মালদ্বীপকে তাই ছোট বলা যায় না। কিন্তু প্রতিরক্ষায় এটি বিশাল। এই নিরাপত্তা কীভাবে সম্ভব? প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং রিয়েল টাইম স্যাটেলাইট ডাটার মাধ্যমে সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র চারটি পেট্রোল বোট দেবে। এয়ারক্রাফ্টও দিতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও মোকাবেলা করতে হবে। তিনি বলেন, ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র বড় শক্তি। কিন্তু ভারত আরও বড় শক্তি। তাই ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এক সঙ্গে কাজ করবে।