মঙ্গলবার   ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আশ্বিন ৮ ১৪৩২   ৩০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

মিয়ানমারে অনিশ্চিত পরিস্থিতি বাংলাদেশ সীমান্তে তুমুল যুদ্ধ

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৪:১৪ এএম, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ শনিবার


 

বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে তুমুল যুদ্ধ চলছে। দেশটিতে ক্ষমতার মসনদে থাকা সামরিক জান্তার নিয়মিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মি নামের বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে চলছে এই যুদ্ধ। জান্তার বাহিনী বিমান, স্থল এবং জলপথে অভিযান পরিচালনা করছে। সেই তুলনায় সমরাস্ত্রে দুর্বল আরাকান আর্মি গেরিলা হামলা পরিচালনা করছে। গেরিলা হামলা এতটাই কঠিন যে জান্তার বাহিনীর অনেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি), সেনাবাহিনী, তাদের পরিবারের সদস্য। প্রাণ বাঁচাতে তারা বাংলাদেশকে নিরাপদ মনে করেছে। সব মিলিয়ে ৩৩০ জন এসেছিল। তাদের সবাই ফেরত গেছে। তাদেরকে অবশ্য বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক চ্যানেলে আলাপ-আলোচনা করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, ২০১৭ সালে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে তাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিল। আজ নির্যাতনকারী বাহিনীর সদস্যরা নিজেরাই নিরাপদ স্থান না পেয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলো। গোলাগুলির শব্দে সীমান্ত এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। যুদ্ধের সময়ে মর্টারশেল বাংলাদেশের ভূখন্ডেও পড়ছে। মর্টারের আঘাতে বাংলাদেশের মধ্যে দুইজন মারা গেছেন। ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় অভিযান পরিচালনার সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে যাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনও গুলি না পড়ে। মিয়ানমারের সামরিক বিমানগুলো অভিযান পরিচালনার সময় প্রায়ই বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘিত হচ্ছে। মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী মোতায়েন বাড়ানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আর কোনও মিয়ানমার শরণার্থী সেটা রোহিঙ্গা কিংবা অন্য কেউ যেই হোক না কেন তাদের আর গ্রহণ করা হবে না।
মিয়ানমার ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করার পর বেশিরভাগ সময় সামরিক শাসন দিয়ে দেশ পরিচালনা করেছে। ২০১১ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার ভাগাভাগি ধরনের এক প্রকার গণতন্ত্র চালু হয়। নোবেল বিজয়ী অং সান সুচি’র দল ‘ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি’ (এনএলডি) বেশি আসন পায়। সুচি সরকার গঠন করলেও মূল ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতেই থেকে যায়। কারণ মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী, প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র প্রভৃতি নিরাপত্তা সংক্রান্ত পাঁচটি মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত থাকে। কিছু অভ্যন্তরীণ সংস্কার হয়, সে কারণে প্রচুর বিদেশী বিনিয়োগ হয়। ২০১৫ সালের নির্বাচনেও এনএলডি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ২০১৯ সালে নির্বাচনেও সুচি’র বিপুল বিজয় অর্জিত হয়। তখনই সেনাপ্রধান জেনারেল হ্লায়িংয়ের সঙ্গে সুচি’র বিরোধ দেখা দেয়। ২০২১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি সুচিকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয় সেনাবাহিনী।      
মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকে তার বিরুদ্ধে সুচি সমর্থকরা আন্দোলনে নামেন। তার জবাবে সেনাবাহিনী নিষ্ঠুরতা শুরু করলে আন্দোলনকারীরাও অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। মিয়ানমারে ৬০ শতাংশের বেশি জনগোষ্ঠী হলো বামার জনগোষ্ঠী। বামাররা কট্টর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোক। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশের বেশি মানুষ ১৩৫টি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোক। বামার জনগোষ্ঠী ছোট জাতিগুলোকে সহ্য করতে পারে না। সুচি অবশ্য ক্ষমতায় থাকাকালে পাংলং সম্মেলন করেছিলেন। এই সম্মেলনে ১৩৫ জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংহতি প্রতিষ্ঠা করে জাতীয় ঐক্য গড়ার ইচ্ছা প্রকাশিত হয়েছিল। সেনারাতো নয়ই, সুচি পর্যন্ত সাধারণভাবে মুসলমানদের সহ্য করতে পারেন না। রোহিঙ্গা মুসলমানদের নামই শুনতে পারেন না। সুচি ক্ষমতায় থাকাকালে একবার বিবিসি’র সাংবাদিক মিশাল হোসেন তার সাক্ষাৎকার নিতে গেলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে সাংবাদিককে বলেন, আপনি মুসলমান এটা আগে জানলে আমি আপনাকে সাক্ষৎকার দিতাম না। এতটাই ঘৃণা মুসলমানদের প্রতি, রোহিঙ্গাদের প্রতি।
মিয়ানমারের জান্তার শাসকরা চীনের অনুগত বলে মনে করা হয়। সুচি পশ্চিমা আশির্বাদপুষ্ট। চীনের অনুগত সরকার হওয়ায় সামরিক জান্তার প্রতি পশ্চিমা বিশে^র সমর্থন নেই। মিয়ানমার দেশটির তাই বর্হিবিশে^ যোগাযোগ তেমন নেই। ফলে অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্যে দেশটির শাসকরাও পর্দার আড়ালে মাদক ব্যবসায়ী, অনলাইনে ক্যাসিনো পরিচালনাকারী, অনলাইন স্ক্যাম ঘিরে অর্থের ভাগ-বাটোয়ারায় যুক্ত হয়। এসব বিষয়ের পাশাপাশি মিয়ানমারের সীমান্তে প্রতিটি রাজ্যে সামরিক জান্তার বাহিনীর সঙ্গে পৃথক বিদ্রোহী গ্রুপের যুদ্ধ চলছে। বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন রাখাইন রাজ্যের বিদ্রোহী গ্রুপের নাম আরাকান আর্মি। অন্যান্য রাজ্যে কাচিন, কারেন প্রভৃতি বিভিন্ন নামে বিদ্রোহী গোষ্ঠী যুদ্ধ করছে। মিয়ানমারের পরিস্থিতির প্রতি বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন সবাই ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখছে। সেখানে জান্তা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে নাকি তার পতন ঘটবে সে ব্যাপারে কোনও ধারণা করা মুশকিল। তবে গৃহযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মিয়ানমারে পরিস্থিতি খুবই অনিশ্চিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জান্তা বিরোধীদের নিয়ে গঠিত প্রবাসী সরকার ‘ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট’ (এনইউজি)কে অস্ত্র ছাড়া অর্থসহ অন্যান্য কিছু দিয়ে সহায়তা করছে। ‘বার্মা অ্যাক্ট’ নামের মার্কিন আইন এই সহায়তার ভিত্তি। কেউ কেউ মনে করেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি দিয়ে কাজ করার আগ্রহের নেপথ্যে মিয়ানমারের পরিস্থিতি গুরুত্ববহ।
আরাকান আর্মি বর্তমানে রাখাইন রাজ্যের ৭০ শতাংশ দখলে নিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে টেকনাফের বিপরীতে মংডু অঞ্চলে জান্তার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। রাখাইন সম্প্রদায়ের বৌদ্ধদের সমন্বয়ে গঠিত আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যে স্বায়ত্তশাসন চায়। তারা এখন স্বীকৃতি লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সম্পর্ক নেপিদো’র সঙ্গে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয়ভাবে ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তার সরকারের সঙ্গেই বাংলাদেশের সম্পর্ক। ভারত জোরালোভাবে জান্তাকে সমর্থন করে। ভারতের অবস্থানকে পুরোপুরি সমর্থন করছে না বাংলাদেশ। সম্প্রতি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল গোপনে বাংলাদেশ সফর করে মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। দুই দেশ পুরোপুরি একমত হয়েছে বলে মনে হয় না। ঢাকা পরিস্থিতি নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছে। বঙ্গোপসাগরে এক্সেস পেতে সকল দেশই বদ্ধপরিকর। পরিস্থিতি কোন দিকে অগ্রসর হয় সেটা বোঝা মুশকিল। তবে বাংলাদেশের সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলে অনেকের অনুমান।