শেখ হাসিনার সামনে কঠিন সময়
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে -
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৩:১৬ এএম, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ শনিবার

ডলার সংকট, নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্য, দুর্নীতির কালো ছায়া, দলে কোন্দল-বিভক্তি
কোনও একটি দেশের নতুন সরকারের প্রথম ১০০ দিনকে বলা হয় হানিমুন পিরিয়ড। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর শেখ হাসিনার নতুন সরকারের এখন চলছে সেই মধুচন্দ্রিমা কাল। কিন্তু নানা সংকটে এই সময়েই দুশ্চিন্তায় সরকার। ডলারের সংকট, নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্য, দুর্নীতির কালো ছায়াসহ নানাবিধ সংকটে পরিস্থিতি এখনই জটিল। তার ওপর আওয়ামী লীগের মধ্যে দলাদলি চরম আকার ধারণ করেছে। নতুন করে মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের কথাও উঠছে। সংরক্ষিত কোটায় এমপি হতে নারীদের মধ্যে শুরু হয়েছে দৌড়ঝাঁপ। যদিও বিএনপি’র বর্জনের মাধ্যমে হয়ে যাওয়া নির্বাচনকেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ‘অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি’ বলে মন্তব্য করেছে। ফলে সামনে কঠিন সময়।
ডলার সংকট কাটানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশে ডলার আসে দুইটি উৎস থেকে। তার মধ্যে একটি হলো রফতানি খাত; অপরটি রেমিট্যান্স। দুইটি খাতই এখন সংকটে। ডলারের দাম বাড়ছে। ডলারের রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আমদানির এলসি খোলা যাচ্ছে না। চলতি বছর থেকে সরকার মেগা প্রকল্পের ঋণের অর্থ পরিশোধ করবে। এতে ডলার সংকটের তীব্রতা বাড়তে পারে। যদিও চীন বলছে, ডলার সংকটে তাদের সরকার বাংলাদেশের পাশে থাকবে। বাংলাদেশের চাহিদার ৪০ শতাংশ জ¦ালানী বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এতেও ডলার ব্যয় হচ্ছে।
এদিকে, জিনিসপত্রের দাম লাগামহীন বাড়তে থাকায় মধ্যবিত্তের নাভিশ^াস উঠছে। ভরা মওসুমে পেয়াঁজের দাম সেঞ্চুরি ছাড়িয়ে গেছে। পণ্যমূল্য বৃদ্ধিও অন্যতম কারণ সিন্ডিকেট করে লুটেরা ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা অর্জন করে। এসব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনও সরকার কোনও পদক্ষেপ নিতে পারেনি। কিন্তু এবার শেখ হাসিনার সরকার চুপ করে থাকলে সরকারের অবকাঠামো উন্নয়ন কাজের সবকিছু ম্লান করে দিতে পারে দ্রব্যমূল্য। বিশেষ করে লুটেরা ব্যবসায়ীরা পবিত্র রমজান মাসকে জিনিসপত্রের বেশি দাম নেবার মোক্ষম সময় বিবেচনা করে থাকে।
অপরদিকে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, বাংলাদেশ দুর্নীতিপরায়ন দেশ হিসাবে এখনও খারাপ অবস্থানে আছে। এসব নিয়ে নতুন সরকারের মধ্যে অস্বস্তি কাজ করছে। দুর্নীতির লাগাম এবারও কতটা টানা যাবে সেটাই প্রশ্ন সাপেক্ষ। দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি এক শতাংশ কম হচ্ছে। বিশেষ করে ব্যাংক ব্যবস্থা খুবই নাজুক অবস্থায় পড়েছে। অনেক মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। প্রতি তিনমাস পর পর বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপির যে হিসাব প্রকাশ করে তাতে প্রতিবারই খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে বলে দেখা যায়। বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার কথা শোনা যায়। এসব বিষয়ে শেখ হাসিনা শক্ত পদক্ষেপ নিতে গেলে প্রভাবশালী মহলের রোষানলে পড়তে হবে। আবার শক্ত পদক্ষেপ না নিলে খেলাপি ও অর্থ পাচারের ব্যাধি ক্যান্সারে পরিণত হবে।
বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করায় সরকার ভোটকে বিশ^াসযোগ্য করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত পদক্ষেপ হলো, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীকের বাইরেও স্বতন্ত্র নির্বাচন করার জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। এতে করে নির্বাচনে ৬৫ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করার কারণে সংসদে এক ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জাতীয় পার্টি মাত্র ১১ জন সংসদ সদস্য নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসে। এতে করে জাতীয় সংসদ কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন ঘোষণা করবে আওয়ামী লীগ। ইতিমধ্যে ৪৮টি নারী আসন আওয়ামী লীগ পাবে বলে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। জাতীয় পার্টি পাচ্ছে ২টি নারী আসন। নারী আসনে এমপিরা শপথ গ্রহণের পর মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নবগঠিত মন্ত্রিসভায় কিছুটা চমক ছিল। ৩৭ সদস্যের মন্ত্রিসভায় নতুন যুক্ত হয়েছেন ১৪ জন। এই তালিকায় স্থান পায়নি বিদায়ী মন্ত্রিসভার ২৮ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী। তবে কিছু কিছু মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে রাখা হয়েছে। এসব মন্ত্রণালয়ে নতুন মন্ত্রী দেওয়া হতে পারে। মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ হলে ৫-৭ জন নতুন মুখ যুক্ত হতে পারেন। সংসদকে কার্যকর করানোর বিষয়ে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিরোধী দল সংসদে নিয়মিত হাজির না হলে সংসদ কার্যকর করা কঠিন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি’ বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো। এ কারণে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানায়নি। যদিও ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অনেক দেশই অভিনন্দন জানিয়েছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে আন্তরিক প্রচেষ্টা না হলে পশ্চিমারা সন্তুষ্ট হবে না।
পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। বড় শক্তিগুলি ব্যাপক ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা করছে। ফলে বাংলাদেশে অনেক উন্নয়ন কর্মকান্ড অযথা অনিশ্চয়তায় পড়ে। তার সর্বশেষ উদাহরণ তিস্তা নদীকে ঘিরে চীনের অর্থায়নে প্রকল্প গ্রহণ। চীনের তিস্তা প্রজন্ম যে উদ্যোগ নিয়েছে; ভারত সেটা ভালভাবে দেখছে না। এ নিয়ে প্রকল্পটি এখন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে এই প্রতিযোগিতা অন্যান্য ক্ষেত্রে হচ্ছে। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই)-এ বাংলাদেশ যুক্ত হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর বেশ চাপ দিচ্ছে। নির্বাচনের আগেও গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু ভোট আয়োজন করতে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি প্রয়োগ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এসব পদক্ষেপের মূলে ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য আছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে আছে। বাংলাদেশকে চীন থেকে ‘ডি-কাপলিং’ করতে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার কিংবা গণতন্ত্রকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে বলে কোনও কোনও বিশ্লেষক মনে করেন। এসব কারণেও শেখ হাসিনার সরকারকে চাপে থাকতে হচ্ছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা তথা স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও দলীয় প্রতীক ব্যবহার করবে না আওয়ামী লীগ। সংসদ নির্বাচনে দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায় ক্ষমতাসীন দলে কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে। অনেক স্থানে মারামারিতে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। ফলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শেখ হাসিনা সরকারের জন্য সামনে কঠিন সময় আসছে। এখন এই সমস্যা কিভাবে মোকাবিলা করবে সরকার তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।