বাংলাদেশে দুই নৌকায় পা রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৫৯ এএম, ২০ জানুয়ারি ২০২৪ শনিবার

আপাতত নতুন সরকারকে অভিনন্দন নয়, তবে একত্রে কাজ শুরু
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে -
শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন জানাবে না বাইডেন প্রশাসন। প্রথা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শেখ হাসিনা শপথ গ্রহণের পর পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কিংবা পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের তাকে অভিনন্দন জানানোর কথা। অভিনন্দন না জানালেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ইস্যুতে দুই নৌকায় পা দিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠন হয়েছে। নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদসহ একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এসব বৈঠকে বাংলাদেশে নতুন সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন না জানিয়েও ধীরে ধীরে নতুন সরকারের অগ্রাধিকারসমূহ দেখে সেগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জায়গায় একত্রে কাজ করবে বলে মনে হচ্ছে। একজন পশ্চিমা কূটনীতিক আজকালকে বলেন, এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানানোর কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একাধিক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সফর বাংলাদেশে হয়েছে। প্রায় প্রতিটি সফরকালে মার্কিন কর্মকর্তারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চান বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। এক পর্যায়ে বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। এই নীতির আওতায় কেউ নির্বাচনে বাধা দিলে তাকে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। বাধাদানকারী এবং তার নিকট আত্মীয়ের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বাতিল হবে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতির প্রয়োগও করেছে। তবে কারা এই ভিসানীতির আওতার মধ্যে পড়েছে; ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র তা প্রকাশ করেনি। ফলে ভিসানীতির প্রভাব দৃশ্যমান নয়।
ভোটের বেশ কিছুদিন আগে প্রচার করা হয় যে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বিএনপির পক্ষে কার্যক্রম করছে। তারপর যুক্তরাষ্ট্র কৌশল পাল্টে হাসকে নীরব ভূমিকা পালনের নির্দেশ দেয়। বিএনপি ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নিলে ভোটের ফলাফল জানা হয়ে যায়। তবে নির্বাচনে প্রায় ৪২ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি এবং ভোটের দিনে বড় কোনও সহিংসতার ঘটনা না ঘটার কারণে ভোটের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে জারি করা বিবৃতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লক্ষ্য করেছে যে, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ লাভ করেছে। তবে বিবৃতিতে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলেও মন্তব্য করা হয়। যদিও এটা বলা হয়েছে যে, নতুন সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করবে। বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে এও বলা হয় যে, বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার সদস্যের গ্রেফতার ও নির্বাচনের অনিয়মের খবরে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, অন্য পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র একমত যে বাংলাদেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। এতে সব দল অংশ না নেওয়ায় হতাশও ব্যক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন বলয়ভুক্ত একটি দেশের কূটনীতিক আজকালকে বলেছেন, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় তাদের দলের নেতাকর্মী এবং অনুসারীরা ভোট দেবার মতো পছন্দের প্রার্থী পাননি। এটাকেই বৃহত্তর দৃষ্টিতে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। ঢাকায় অপর একজন ইউরোপীয় কূটনীতিক বলেন, ভোটার উপস্থিতি ১৫ শতাংশের কম হলে তাকে ব্যর্থ ভোট বলা যায়। এমন ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো ভোটের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ভোটার উপস্থিতি খুব বেশি না হলেও পশ্চিমা বিশ্বের নির্বাচনের তুলনায় ৪২ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি কম নয়। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এখনই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তেমন কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তবে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন না জানিয়ে বর্তমান সরকারকে চাপে রাখবে বলে মনে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র শুধু ভোট নয়; বরং এশিয়ায় ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যেও কাজ করে। সেক্ষেত্রে, বাংলাদেশের চীনের দিকে হেলে থাকাকে মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করে। বাংলাদেশ এরইমধ্যে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) যোগ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, বাংলাদেশ যেন তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে যোগ দেয়। বাংলাদেশ এই অঞ্চলে সামরিক প্রতিযোগিতা চায় না। অর্থনৈতিক সহযোগিতা কামনা করে। বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল দেশ। টানা বছরের পর বছর ছয় শতাংশের বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এসব কারণে ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এদিকে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠকের পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থকে এগিয়ে নিতে আগামী দিনগুলোতে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করার অপেক্ষায় আছি। বাণিজ্য, জলবায়ু পরিবর্তন এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে ওয়াশিংটন ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে। গত বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে প্রথম সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। পিটার হাস আরও বলেন, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করার লক্ষ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণ, জঙ্গি দমন এবং ধর্মান্ধতা মোকাবেলাসহ সবক্ষেত্রে এক সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনার কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। মন্ত্রী বলেন, আমাদের নতুন সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকাকে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মার্কিনীদের ‘দ্বৈতনীতি’ আখ্যা দিয়েছেন। তারা বলেছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমেরিকা দুই নৌকায় পা দিয়ে রেখেছে।