ভোট বিতর্কের মধ্যে নতুন সরকারের যাত্রা শুরু
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৩:২৬ এএম, ১৩ জানুয়ারি ২০২৪ শনিবার

টানা চারবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা : তিন দশকের মধ্যে ছোট মন্ত্রিসভা
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের প্রশ্নের মধ্যেই যাত্রা শুরু করেছে শেখ হাসিনার নতুন সরকার। অভিজ্ঞদের প্রাধান্য দিয়ে গঠিত হয়েছে নতুন মন্ত্রিসভা। তবে ৩৬ মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী নিয়ে গঠিত মন্ত্রিসভা দৃশ্যত গতানুগতিক হলেও কিছু নতুন মুখ রয়েছে। এবার বাদ পড়েছেন ২৮ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী। তবে বাংলাদেশে তিন দশকের মধ্যে এবার সবচেয়ে ছোট মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে।
পঞ্চম মেয়াদে ক্ষমতায় গিয়ে শেখ হাসিনাকে বর্হিবিশে^র এবং অভ্যন্তরীণ কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। ভারত, পাকিস্তান, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়াসহ আঞ্চলিক দেশগুলো শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানালেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, ইইউসহ পশ্চিমা দেশগুলো নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। বিশেষ করে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
নির্বাচনের মান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সমালোচনার জায়গা একটাই, সেটা হলো, ভোটে অংশ নিয়েছে দুই বড় দলের একটি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আরেক বড় দল বিএনপি অংশ নেয়নি। পশ্চিমারা মনে করে, অনেক মানুষই তাদের পছন্দের প্রার্থী পায়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিক্রিয়া কোনও বিস্ময়কর কিছু নয়। এই ধরনের প্রতিক্রিয়া অপ্রত্যাশিতও নয়। তবে সরকারের ভেতরের লোকেরা মনে করেন, ২০১৪ সালের এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর প্রতিক্রিয়া আরও কড়া ছিল। কিন্তু পর্যায়ক্রমে তারা মেনে নিয়ে সরকারের সঙ্গে কাজ করেছে। এবার আগেভাগেই বলে দিয়েছে, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করবে। সরকারের রাষ্ট্রাচার বিভাগ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের অভিনন্দন জানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। বেশিরভাগ দেশ সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া এবং ইইউ রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অভিনন্দন বার্তা দিতে অস্বীকার করেছে। যদিও দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতেরা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন। বঙ্গভবনে নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ সব দেশের রাষ্ট্রদূত। বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন মন্ত্রী পদ থেকে বাদ পড়ার পূর্বেই ফরেন সার্ভিস একাডেমীর সবুজ চত্ত্বরে ‘মিট অ্যান্ড গ্রিট’ অনুষ্ঠানের বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন। সেখানে পিটার হাসসহ যুক্তরাজ্য, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, ইইউ রাষ্ট্রদূত অংশ নেন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পর সংসদে ২৯৮টি আসনের সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেছেন। স্থগিত ২টি আসন বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের ২২২টি, স্বতন্ত্র ৬৩, জাতীয় পার্টির ১১টি, ওয়ার্কার্স পার্টির একটি এবং কল্যাণ পার্টির একটি আসনে বিজয়ী প্রার্থী শপথ গ্রহণ করেছেন। সংসদীয় পদে কোনও পরিবর্তন হয়নি। শিরিন শারমিন চৌধুরী স্পীকার, শেখ হাসিনা সংসদ নেতা, মতিয়া চৌধুরী উপনেতা এবং নূরে আলম চৌধুরী প্রধান হুইপ নিযুক্ত হয়েছেন। তবে বিরোধী দলের আসনে কারা বসবে তার কোনও ফয়সালা হয়নি। বর্তমান রেওয়াজ অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া জাতীয় পার্টি হতে পারে বিরোধী দল। সেক্ষেত্রে দলটির প্রধান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ভাই জি এম কাদের হতে পারেন বিরোধী দলীয় নেতা। জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে থাকার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে ক্ষমতাসীন দলের বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হলে স্বতন্ত্ররা একটি গ্রুপ করে বিরোধী দল হতে চাইলে তারাও বিরোধী দল হতে পারে। এক্ষেত্রে আইনে কোনও বাধা নেই। স্বতন্ত্ররা বিরোধী দল হলে তার নেতা হতে পারেন লতিফ সিদ্দিকী। বিরোধী দল কারা হবে আলোচনা করে তার সিদ্ধান্ত নেবেন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা ও স্পীকার শিরিন শারমিন চৌধুরী। বিরোধী দল বলতে যদি রাজনৈতিক দল বোঝায় তবে অবশ্যই জাতীয় পার্টিই হবে বিরোধী দল। আর যদি সরকার বিরোধী সবচেয়ে বড় গ্রুপ বোঝায় তবে বিরোধী দল হবে স্বতন্ত্র গ্রুপ। স্বতন্ত্রদের নিয়ে বিরোধী দল গঠনের কোনও নজির নেই। কিন্তু এবার নতুন নজির হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ ভেতরে ভেতওে বিষয়টি নিয়েও কাজ চলছে।
নির্বাচন এবং ভোটের পরবর্তী প্রক্রিয়ায় শেখ হাসিনা তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়েছেন। বিশেষ করে ছোট বোন শেখ রেহানা, প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং শেখ রেহানার পুত্র রাদওয়ান মুজিব ববিকে বিভিন্ন কাজে প্রধানমন্ত্রীকে সহায়তা করতে দেখা গেছে। বর্তমান মেয়াদ শেষ হলে শেখ হাসিনার বয়স আশি বছর অতিক্রম করবে। পরম্পরার রাজনীতিতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আসা উত্তরাধিকারকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা কিনা এমন আলোচনা বিভিন্ন মহলে চলছে। অপরদিকে, অসুস্থতাজনিত কারণে রাজনীতিতে প্রায় অনুপস্থিত খালেদা জিয়া। তার উত্তরাধিকার স্পষ্টত পুত্র তারেক রহমান। লন্ডনে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত তারেক রহমান বর্তমানে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার মেয়াদ পূর্ণ করতে সমর্থ হলে পরের জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ২০২৯ সাল নাগাদ। ওই নির্বাচনে বিএনপি’র অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। ওই নির্বাচনে অংশ না নিলে দলটি নিবন্ধন হারাবে। বর্তমান সময়ে বিএনপি দল গোছানোর কাজ করবে বলে মনে হচ্ছে। বর্তমানে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের বন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তির বিষয়ে আইনী প্রক্রিয়া চালু আছে। তারা মুক্তি পেলে বিএনপি ও তার অঙ্গ-সংগঠন সম্মেলন করার প্রতি জোর দিতে পারে। পরিপূর্ণ গোছানো দল নিয়েই বিএনপি সরকার বিরোধী আন্দোলন এবং ২০২৯ সালের নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে বলে দৃশ্যত মনে হচ্ছে।
পঞ্চমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন শেখ হাসিনা: টানা চতুর্থবার ও সব মিলিয়ে পঞ্চমবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টা ৩ মিনিটে বঙ্গভবনে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর শপথ বাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে চার মেয়াদে ২০ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ শাসন করেছেন শেখ হাসিনা।
বঙ্গভবনের দরবার হলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন নতুন মন্ত্রীদের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
শপথ নিলেন ২৫ মন্ত্রী ও ১১ প্রতিমন্ত্রী: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের পর তরুণ-প্রবীণদের সমন্বয়ে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর পর একে একে ২৫ মন্ত্রী ও ১১ প্রতিমন্ত্রী শপথ নিয়েছেন।
কে কোন মন্ত্রণালয় পেলেন: মন্ত্রিসভার দপ্তর বণ্টন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্র পরিচালনায় এবার তার সঙ্গী হয়েছেন ২৫ জন মন্ত্রী এবং ১১ জন প্রতিমন্ত্রী। এর মধ্যে ১৪ জন নতুন মুখ।
প্রধানমন্ত্রী তার নিজের কাছে রেখেছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
এছাড়া আ ক ম মোজাম্মেল হককে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ওবায়দুল কাদেরকে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়, আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে অর্থ মন্ত্রণালয়, আনিসুল হককে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনকে শিল্প মন্ত্রণালয়, আসাদুজ্জামান খানকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মো. তাজুল ইসলামকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, মুহাম্মদ ফারুক খানকে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, মোহাম্মদ হাছান মাহ্মুদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ডা. দীপু মনিকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সাধন চন্দ্র মজুমদারকে খাদ্য মন্ত্রণালয়, আব্দুস সালামকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, মো. ফরিদুল হক খানকে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীকে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, নারায়ণ চন্দ্র চন্দকে ভূমি মন্ত্রণালয়, জাহাঙ্গীর কবির নানককে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, মো. আবদুর রহমানকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মো. আব্দুস শহীদকে কৃষি মন্ত্রণালয়, স্থপতি ইয়াফেস ওসমানকে (টেকনোক্র্যাট) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ডা. সামন্ত লাল সেনকে (টেকনোক্র্যাট) স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, মো. জিল্লুল হাকিমকে রেলপথ মন্ত্রণালয়, ফরহাদ হোসেনকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, নাজমুল হাসানকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, সাবের হোসেন চৌধুরীকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং মহিবুল হাসান চৌধুরীকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ১১ প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে নসরুল হামিদকে বিদ্যুৎ বিভাগ, খালিদ মাহমুদ চৌধুরীকে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়, জুনাইদ আহ্মেদ পলককে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, জাহিদ ফারুককে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, সিমিন হোসেন রিমিকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মহিববুর রহমানকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, মোহাম্মদ আলী আরাফাতকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, শফিকুর রহমান চৌধুরীকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, রুমানা আলীকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং আহসানুল ইসলাম টিটুকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।