ভোটের আগে নয়, পরে চ্যালেঞ্জ
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৭:৪৭ এএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ শনিবার

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে
বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বহির্বিশে^র বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে তেমন কোনও চ্যালেঞ্জ নেই। তবে ভোটের পরে নানা চ্যালেঞ্জের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে নির্বাচন ঘিরে সহিংস ঘটনা ঘটে কিনা সে ব্যাপারে বেশ চিন্তিত ওয়াশিংটন। তাছাড়া, ভোট কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতির হারের প্রতিও যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেকের নজর আছে। নির্বাচনের পর বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা কেমন থাকে সেটিও চিন্তার বিষয়। দেশী-বিদেশী চক্রান্তের কারণে আগামী মার্চ নাগাদ দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে বলে আগেই সতর্ক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি শঙ্কিত করছে।
আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলাকে নতুন বছরে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ডিপ্লোম্যাটিক করেসপনডেন্টস এসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ডিকাব) সদস্যদের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মত বিনিময়ের সময় এক প্রশ্নের জবাবে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সব ধরনের সহযোগিতা করছে সরকার। আপাতত নির্বাচনের পর কোনও নিষেধাজ্ঞা আসবে কিনা তা নিয়ে ভাবছে না সরকার। তিনি আরও বলেন, বিদেশি কাউকে সন্তুষ্ট করার জন্য নির্বাচন হচ্ছে না। বিশেষ কোনো দেশ স্বীকৃতি দেবে কি-না সেটিও বড় কোনো বিষয় নয়। বর্তমান সরকারই সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এখনই চিন্তিত বা ভীত হওয়ার কিছু নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব জানান, সরকারকে জানিয়েই ছুটিতে ভারতে যান ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও বৃটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক।
বিদায়ী বছরে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন বহুজাতিক ফোরামে ভোটে বাংলাদেশের বিজয়কে বড় অর্জন হিসেবে উলে¬খ করে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, গত দেড় দশকে উন্নত দেশগুলোর কাছে ঋণগ্রহীতা থেকে তাদের অংশীদার হয়েছে বাংলাদেশ। বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও এদেশের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে।
বৈশ্বিক বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যের সম্পর্ক রক্ষায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশ সব ধরনের যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান ধরে রেখেছে। আমাদের ভূমিকে আমরা কখনও ব্যবহার করতে দেব না। সেটা যদি আমাদের প্রতিবেশী বা অন্য কারও বিরুদ্ধে যায় অথবা অন্য কারও স্বার্থের ব্যাপারও থাকে, তারপরও দেব না। এ ব্যাপারে আমরা পরিষ্কার।
তিনি আরও বলেন, ভারত ও মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী। এ দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের সীমান্ত রয়েছে। সুতরাং আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, উন্নয়ন। আরও কীভাবে উন্নয়ন করা যায় সেই বিষয়টি দেখা। যে কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব, ছায়া যুদ্ধ বা অন্য কিছু আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না। সেজন্য আমরা সবসময় চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে আসছি।
এ প্রসঙ্গে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বন্দ্বে না জড়ানোর বিষয় উলে¬খ করে সচিব বলেন, ২০১৭ সালে মিয়ানমার যখন রোহিঙ্গাদের পাঠাল তখন নানা রকমের উস্কানি ছিল। কিন্তু আমাদের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে বলা হয়েছে, কোনো দ্বন্দ্বে না জড়াতে। কোনো কিছুতেই জড়াইনি। কারণ আমরা কোনো দ্বন্দ্ব চাই না।
বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে বাইডেন প্রশাসন বেশ তৎপর ছিল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে একের পর এক মার্কিন কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেন। তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আহ্বান জানাতে থাকেন। এতে করে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে যে, নির্বাচনে বাধা দিলে ব্যক্তিবিশেষকে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেবে না। এতেও কাজ হয়নি। ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার সমালোচনায় মুখর ছিল। বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে হস্তক্ষেপ করছে সেটা তখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন থেকে হাসের ওপর নির্দেশনা জারি হয় বেশি নড়াচড়া না করার জন্য। যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে বিতর্কে জড়াতে চায়নি। পিটার হাস চুপ থাকেন।
মার্কিন কৌশলের এটা একটা পরিবর্তন বলে ধারণা করা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এটা বোঝাতে চাইছে- নির্বাচনের পর পুরো বিষয়টা মূল্যায়ন করবে। বিশেষ করে সহিংসতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ বেশি। নির্বাচনে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পড়লে কিছুটা নিরাপদ। তবে তার চেয়ে কম ভোট পড়লে তা বাংলাদেশের বিগত নির্বাচনগুলোর ভোটার উপস্থিতির হারের চেয়ে কম হবে। পরিস্থিতি এমন হলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেবার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে শ্রমমান বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কাই বেশি। এমন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ বছরে ১০ বিলিয়ন ডলারের তৈরী পোশাক রফতানি করে থাকে।
নির্বাচনের পর নতুন সরকারের সামনে বেশ কিছু অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বিশ^ পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থায় বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে আসতে পারে। এ জন্যে বাংলাদেশের মধ্যে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে নতুন করে দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ দরকার। এটা একটা চ্যালেঞ্জ। নতুন কোনও প্রকল্প গৃহীত হলে তার অর্থায়ন জোগার করাও কঠিন কাজ। নতুন সরকারের কাছে খাদ্য নিরাপত্তা অগ্রাধিকারে থাকবে। জ¦ালানীর চাহিদা মেটানোর জন্যে কাজ করতে হবে। ব্যাংক খাতের অবস্থা নাজুক। এই খাতে সংস্কার দরকার। এছাড়া, বাংলাদেশে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়ানোও প্রয়োজন। সবকিছু মিলিয়ে ভোটের আগে নয়, পরেই অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে ক্ষমতাসীনদের।