বুধবার   ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আশ্বিন ৯ ১৪৩২   ০১ রবিউস সানি ১৪৪৭

কুড়িয়ে পাওয়া প্লাস্টিকে পরিবেশবান্ধব টাইলস

নিউজ ডেস্ক

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৩:৫৮ পিএম, ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ মঙ্গলবার

ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের লোহার ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া শীর্ণ আদি বুড়িগঙ্গার দুই পাশ যেন প্লাস্টিক বর্জ্যরে ভাগাড়। শুধু এখানেরই নয়, রাজধানীর অনেক এলাকার বর্জ্য এখানে ফেলা হচ্ছে। চারপাশটা এতটাই দুর্গন্ধ যে, নাক-মুখ চেপেও পথচলা কষ্টকর। এর মধ্যেই কাজ করছেন একদল শ্রমিক। যারা ফেলে দেওয়া নানা বর্জ্য থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য আলাদা করছেন। এই ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বর্জ্য থেকেই পরবর্তী সময়ে উৎপাদন হচ্ছে পরিবেশবান্ধব টাইলস্সহ বিভিন্ন পণ্য। উৎপাদিত টাইলস্ রাস্তার পাশে ফুটপাত, গাড়ি পার্কিংয়ের গ্যারেজে, ছাদবাগানে চলাচলের পথ তৈরিসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার হচ্ছে। শুধু তাই নয়, উৎপাদিত এইসব পণ্য ২৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত টেকসই হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু কামরাঙ্গীরচর এলাকাতেই প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে পণ্য উৎপাদনে প্রায় ৩ হাজার কারখানা গড়ে উঠেছে। তবে সব কারখানাই পরিবেশবান্ধব নয়। ফলে কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের রয়েছে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি। এ ছাড়া কারখানাগুলোও টেকসইভাবে গড়ে না ওঠায় তারা উন্নত কারখানার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হিমশিম খাচ্ছে। আর এ বিষয়েই কাজ করছে রিসোর্স ইনটিগ্রেশন সেন্টার (রিক)। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সার্বিক সহায়তায় রিকের সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রকল্পের আওতায় (এসইপি) ছোট ও মাঝারি প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে সহায়তা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) টাইলসের মান নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নে শুরু থেকে এই প্রকল্পের সঙ্গে কাজ করছে। সম্প্রতি রাজধানীর শ্যামপুর, কামরাঙ্গীরচর ও লালবাগ এলাকায় প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কারখানা সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, প্লাস্টিক থেকে টাইলস্সহ বিভিন্ন ব্যবহার্যপণ্য তৈরি করা হচ্ছে।

প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে টাইলস্ তৈরি করা হোসেইন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের স্বত্বাধিকারী নাজির হোসেইন বলেন, মাটি দিয়ে যদি টাইলস তৈরি করা যায়, তাহলে কেন প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি করা যাবে না। এ ছাড়া এখানে প্লাস্টিক বর্জ্যরে ভাগাড় থাকায় মনে হলো এটা গলিয়ে সহজেই টালইস্ তৈরি করা সম্ভব। পরে নিজেই ছাঁচ তৈরি করে টাইলস বানিয়ে ফেললাম।

তিনি বলেন, দেশে এত প্লাস্টিক বর্জ্য আছে যে, কাঁচামালের কোনো অভাব হবে না। এছাড়া প্লাস্টিকের টাইলসগুলো ওজনে হালকা এবং মাটি বা সিরামিকের টাইলসের চেয়ে অনেক বেশি সাশ্রয়ী হবে। এগুলো পরিবহণ ও স্থাপন করা সহজ। সংশ্লিষ্টরা জানায়, বিশ্বে প্লাস্টিক টাইলসের ব্যবহার নতুন কিছু নয়। ইতোমধ্যে ভারত, মিসর, কেনিয়াসহ আরও কিছু দেশ এর বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু করেছে।

কামরাঙ্গীরচরে প্লাস্টিকের বর্জ্য থেকে নানা পণ্য তৈরির আরেক কারখানা মেসার্স ইউসুফ স্যানিটারি। এই কারখানার স্বত্বাধিকারী ইউসুফ বলেন, তিনি প্লাস্টিকের বর্জ্য থেকে টয়লেটের প্যান, পিভিসি পাইপ, চারাগাছ রাখার ট্রেসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করেন। তার এসব পণ্য ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্রি হয় বলে তিনি জানান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আগে তার কারখানা এত পরিবেশবান্ধব ছিল না। কিন্তু এখন পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া ফিনিশড্ পণ্য, কাঁচামাল ইত্যাদি রাখার জন্য পরিকল্পনামতো কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। তিনি বলেন, পণ্যের কোয়ালিটি মানোন্নয়নের পাশাপাশি শ্রমিকদের নিরাপত্তায় নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় বলে জানান তিনি।

বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার ও দূষণ, উভয়ের পরিমাণই খুব দ্রুত বাড়ছে। ১৫ বছরের ব্যবধানে প্লাস্টিকের ব্যবহার তিনগুণ বেড়েছে। দেশের নগর অঞ্চলে ২০০৫ সালে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ৩ কেজি, যা ২০২০-এ বেড়ে ৯ কেজি হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ৯ লাখ ৭৭০ হাজার টন প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে মাত্র ৩১ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়। প্লাস্টিক বর্জ্যরে মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুরবস্থা হয় একবার ব্যবহার উপযোগী পণ্য, যেমন শপিংব্যাগ, প্যাক করার উপকরণ ইত্যাদি। জাতীয় টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক রিসাইকেল করা, ২০২৬ এর মধ্যে ৯০ শতাংশ একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য থেকে সরে আসা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।

এ প্রসঙ্গে রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টারের (রিক) প্রজেক্ট ম্যানেজার আশফাকুর রাহমান আশা বলেন, দেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবসা ও এর বর্জ্য অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে, যা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট করছে। এ প্রেক্ষাপটে প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেলিং উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। তবে রিসাইকেল প্রক্রিয়াটিকে পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্যই কাজ করছি।