বুধবার   ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আশ্বিন ৯ ১৪৩২   ০১ রবিউস সানি ১৪৪৭

১০ ডিসেম্বর কি কিছু ঘটছে?

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৫:২২ পিএম, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩ শনিবার

বাংলাদেশে নির্বাচন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতি : চাপে আ.লীগ-বিএনপি

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে -
আগামী ১০ ডিসেম্বরকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও নানা গুঞ্জন ডালপালা মেলেছে। সবার দৃষ্টি এখন দশ ডিসেম্বররের দিকে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের ওইদিনে দেশব্যাপী মানববন্ধনের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। একটি মহল বলছে, ওইদিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নতুন করে কোনো নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। তবে এটি বিএনপি’র গুজব বলেই মনে করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।  
ওইজাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশে দুই বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বেশ চাপে পড়েছে। বিএনপি যুগপৎ আন্দোলন করে কিভাবে সরকারের পতন ঘটাবে সেই মানসিক চাপে যেমন রয়েছে তেমনি বিএনপি অংশ না নেয়ায় ভোটকে বিশ^াসযোগ্য করতে বেশি ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সামনে।
ভোটের ফলাফল আগে-ভাগে জেনে যাওয়ায় ভোট কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি কম হওয়ার আশঙ্কা আছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের আরেক মেয়াদে সরকার গঠন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ফলে সাধারণ ভোটারদের মাঝেতো বটেই; ক্ষমতাসীন দলের ভোটারদের মধ্যেও উৎসাহের ভাটা থাকতে পারে। এই সমস্যা দূর করতে আওয়ামী লীগ নিজের দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার অনুমতি দিয়েছে। তাছাড়া, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন দেখাতেও আওয়ামী লীগ এই পদক্ষেপ নিয়েছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনেও বিএনপি বয়কট করেছিলো। তখন ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হয়ে যান। ওই নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন নির্বাচন দাবি করে। কিন্তু বাংলাদেশ এমন নির্বাচনের বিরোধিতা করায় শেষ পর্যন্ত নতুন নির্বাচন হয়নি। এবার অবশ্য বিএনপি নির্বাচন না করলেও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের কেউ নির্বাচিত হতে পারবে না।
নির্বাচনকে উৎসবমুখর করতে এবং কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে এবার আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে দেয়ায় নিজের দলের মধ্যে হানাহানি সৃষ্টি হয়েছে। অনেক জায়গায় বিরোধ প্রকাশ্য রূপ ধারণ করেছে। শরিক দলগুলোও অনেক বেশি আসন চাইছে। হাসানুল হক ইনুর জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন প্রভৃতি নেতাদের নিয়ে গঠিত ১৪ দল, প্রয়াত এরশাদের জাতীয় পার্টি, নাজমুল হুদার প্রতিষ্ঠিত তৃণমূল বিএনপি প্রভৃতি দলগুলো আসন পেতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দরকষাকষি শুরু করেছে। এসব দলের জন্যে আওয়ামী লীগ ৫০টি আসন ছাড়তে পারে। জাতীয় পার্টিসহ এসব দল নিজেদের দলের প্রতীক ব্যবহার না করে ‘নৌকা’ প্রতীক ব্যবহারে আগ্রহী।
নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্যে সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ। মনোনয়নপত্র জমা দেবার তারিখ শেষ। অনেক প্রার্থীর মনোনয়ন যাচাই করার সময় অনেক প্রার্থীর মনোনয়ন বাদ পড়েছে। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার প্রার্থীও রয়েছেন। কেউ কেউ আপীল করছেন। এসব আপীলের ওপর শুনানি হবে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় পার হবার পর আগামী ১৭ ডিসেম্বর থেকে প্রচার শুরু করার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে প্রশাসনে ও পুলিশ অনেক রদবদল করেছে নির্বাচন কমিশন। আচরণবিধি লংঘণে শোকজ করছে।
বিএনপি’র সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, দলের নেতাকর্মীদের হতাশা দূর করা। ২৯ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে রাজধানী ঢাকায় যে তান্ডবলীলা চলেছে; তারপর বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির অধিকাংশ সক্রিয় নেতাকর্মী কারাগারে। এই অবস্থায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। অবরোধ ও হরতাল নিয়মিত ডাকছে। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় এসব কর্মসূচির কোনও প্রভাব নেই। দোকানপাট, অফিস-আদালত খোলা, রাস্তাঘাটে যানবাহন চলছে। মাঝেমধ্যে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে একটা-দুইটা বাসে আগুন দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। তবে হরতাল ও অবরোধে দূর পাল্লার বাস চলাচল করে না। আমদানি-রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নেতা-কর্মীদের নামে মামলা থাকায় এবং নির্বাচন বিরোধী হওয়ায় সমাবেশ করার অনুমতি না পাওয়ার আশঙ্কা করছে বিএনপি। তাই আগামী ১০ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে দেশব্যাপী মানববন্ধনের কর্মসূচি দিয়েছে। এই মানববন্ধনে প্রধানত বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় দলের যেসব নেতা-কর্মী কারাগারে রয়েছেন; তাদের আত্মীয়-স্বজনরা সামনে থাকবেন। এছাড়াও, বিএনপি’র যেসব নেতা-কর্মী গুম-খুনের শিকার হয়েছেন; তাদের স্বজনরাও মানববন্ধরে থাকবেন। বিএনপি’র উদ্দেশ্য, বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘিত হওয়ার চিত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরা। সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কী ব্যবস্থা নেয় সেটার অপেক্ষায় আছে বিএনপি। তবে দলটির নেতারা একটা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। সেটা হলো, শাহজাহান ওমর ছাড়া আর কোনও বড় নেতা আওয়ামী লীগে যোগদান করেননি। স্বেচ্ছায় কিংবা চাপের মুখে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে পরের দিনই দলের মনোনয়ন লাভ করেন।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রত্যাশা করে। কেউ সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে তার বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে ঘাটতির কারণে উগান্ডা ও জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে নির্বাচনের পূর্বে যুক্তরাষ্ট্র কোনও পদক্ষেপ নেবে না বলেই অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে। তবে নির্বাচন গুণগতমানে খারাপ হলে যুক্তরাষ্ট্র কী ভূমিকা নেয় সেটিই এখন দেখার জন্যে অপেক্ষা। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে শ্রমনীতি ঘোষণা করে রেখেছে। মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত সলিডারিটি সেন্টারের শ্রমিক নেতা কল্পনা আক্তার এবং বাবুল আক্তারকে বাংলাদেশ সরকার হয়রানি করলে মার্কিন শ্রমনীতি ব্যবহার করে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা যাবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র একটি দেশের ঢাকায় নিযুক্ত এক কূটনীতিক না প্রকাশ না করার শর্তে আজকালকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। এই মূহূর্তে নতুন করে সম্পর্কের আরও অবনতি চাইবে না এই দুই দেশই। তার ওপর বাংলাদেশে রাশিয়া ও চীনের রাষ্ট্রদূত বেশ সক্রিয়। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে স্যাংশন দিলে রাশিয়া ও চীন বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াবে।
ঢাকায় বিদেশী ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় দেখতে চায়। তারা মনে করেন, নতুন কোনও সরকার এলে তাদেরকে ম্যানেজ করে কাজ এগিয়ে নেওয়া কঠিন। দিল্লিতে টু প্লাস টু বৈঠকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আলোচনা হয়েছে। সেখানে ভারত বলেছে, শেখ হাসিনার সরকারের ওপর চাপ দিলে আঞ্চলিক সমস্যা হতে পারে। নির্বাচন নিয়ে উত্তেজনা না থাকায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বেশিরভাগ কূটনীতিক এখন ছুটি কাটাতে থাইল্যান্ড, মলিয়েশিয়ায় চলে গেছেন। ভোটের আগে আগে তারা ঢাকায় ফিরবেন।