বুধবার   ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আশ্বিন ৯ ১৪৩২   ০১ রবিউস সানি ১৪৪৭

বিএনপিকে জেলে রেখে নির্বাচন!

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৫:১৫ এএম, ২৫ নভেম্বর ২০২৩ শনিবার


আওয়ামী লীগের নতুন স্ট্যাটেজি

নাটকীয় কিছুরআশায় বিএনপি


বিশেষ প্রতিনিধি, নিউইয়র্ক ও ঢাকা -
বিএনপি ছাড়াই একতরফা নির্বাচনের সকল আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। কূটনীতিকরা সংকট নিরসনে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি সংলাপের প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেও আওয়ামী লীগ নাকচ করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ বলছে, এখন আর সংলাপের সময় নেই। নির্বাচন কমিশন একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছে। নাটকীয় কোনও পরিস্থিতি ছাড়া এই নির্বাচনে বিএনপি’র অংশ নেবার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ নতুন স্ট্র্যাটেজি নিয়েছে। তারা এবার ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো নয়, এবার নতুন স্টাইলে বিএনপি নেতাদের জেলে রেখে নির্বাচন করবে। ২৮ অক্টোবর সহিংসতার অভিযোগে বিএনপির অধিকাংশ নেতা জেলে রয়েছেন, তাদের মধ্যে কারও কারও জেল-জরিমানাও দেওয়া হয়েছে। ফলে তারা কার্যত নির্বাচন করতে পারবেন না।
এদিকে, আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন প্রায় চূড়ান্ত করেছে। তিনশ’ আসনের জন্যে তিন হাজারের বেশি প্রার্থী ক্ষমতাসীন দলটির মনোনয়ন প্রত্যাশী। প্রতি আসনে গড়ে ১১ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভ করতে আবেদন করেছেন। প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লাহর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কমিটিন করা হয়েছে। কমিটি প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে সারাদেশের প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করেছে। ২৫ নভেম্বর চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে। মনোনয়নে অপেক্ষাকৃত তরুণ যাদের ক্লিন ইমেজ আছে; তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। অনেক স্থানে বর্তমান এমপি মনোনয়ন পাননি।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেই পাস। বিএনপি না থাকলে মাঠে লড়াই তেমন আশা করা যায় না। তাই মনোনয়ন ঘিরেই যত হুলস্থূল। আওয়ামী লীগে মনোনয়ন নিয়ে তীব্র উত্তেজনা দেখা দিলেও বিএনপি প্রায় মাঠ শূন্য। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সহিংসতার পর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সক্রিয় প্রায় সকল নেতাই কারাগারে। মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আলতাব হোসেন চৌধুরীসহ অনেকে কারাগারে থাকায় অনেকটা দিশেহারা কর্মীরা। চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া অসুস্থ। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যেও দলটি প্রায় টানা অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। রাজধানীতে যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমদের নেতৃত্বে স্বল্প সময়ের জন্যে ঝটিকা মিছিল ছাড়া আর কোনও কর্মকান্ড চোখে পড়ে না। রিজভী অজ্ঞাত স্থান থেকে জুমের মাধ্যমে কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ তাদের মিত্র দেশগুলোর কূটনীতিকরা সংলাপ করে সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এসব উদ্যোগে সরকারের সাড়া মিলছে না। সরকার নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে মরিয়া। ঘোষিত তফসিল মোতাবেক, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধান মেনে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন করা বাধ্যতামূলক। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু বিবৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ কেউ দিচ্ছেন। তারা একতরফা নির্বাচনের বদলে বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন করার আহ্বান জানাচ্ছেন। এসবেও সাড়া মিলছে না।
ভোটের মাঠে বিএনপি না থাকায় শূন্য স্থান পূরণে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অনেক দল। তার মধ্যে জাতীয় পার্টি সবচেয়ে বড় দল। জাতীয় পার্টিতে দু’টি ভাগ স্পষ্ট। দলটির প্রতিষ্ঠাতা এরশাদের ভাই জি এম কাদেরের নেতৃত্বে একাংশ সরকার বিরোধী বলে পরিচিত। এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ সরকারপন্থী হওয়ায় তার গ্রুপের প্রার্থীরা সরকারের আর্শীবাদে কিছু কিছু আসনে ছাড় পেতে পারেন। যদিও জাতীয় পার্টি তিনশ’ আসনে প্রার্থী দেবার কথা বলে মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের জাতীয় পার্টি (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু), রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি, হাসানুল হক ইনুর জাসদসহ বিভিন্ন দল নিজেদের প্রতীকের বদলে নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে চাইছে। কিন্তু আওয়ামী লীগে প্রার্থীরা ছাড় দিতে নারাজ। ফলে দলটি বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে আসন বন্টন নিয়ে। আওয়ামী লীগ সর্বোচ্চ ৫০টি আসন শরিকদের জন্যে ছাড় দিতে পারে। তার মধ্যে শুধু জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলীয় জোটের শরিকরাই নয়; বরং নতুন যেসব দলে বিএনপি ঘরানার ব্যক্তিরা নির্বাচনে আগ্রহী হচ্ছেন তাদের জন্যেও আসন ছেড়ে দেবার চাপ রয়েছে।
বিএনপি’র প্রয়াত নেতা নাজমুল হুদার প্রতিষ্ঠিত তৃণমূল বিএনপি ভোটে অংশ নিচ্ছে। দলটি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। নাজমুল হুদার মৃত্যুর পর তার কন্যা অন্তরা হুদা হাল ধরলেও বর্তমানে তিনি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন। নির্বাচন উপলক্ষ্যে তৃণমূল বিএনপি পুনর্গঠন করে তাতে সাবেক বিএনপি নেতা শমশের মবিন চৌধুরীকে সভাপতি ও আরেক সাবেক বিএনপি নেতা তৈমুর আলম খন্দকারকে মহাসচিব করা হয়েছে। এই দলে বিএনপির কিছু কিছু নেতা যোগদান করছেন। তৃণমূল বিএনপিকে কিছু আসন ছেড়ে দিতে পারে আওয়ামী লীগ। সরকার পর্দার আড়ালে কাজ করে বিএনপি নেতাদের তৃণমূল বিএনপিতে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে। এছাড়াও, বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ১২ দলীয় জোটের কিছু কিছু দল এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। তার মধ্যে সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অবঃ) ইবরাহিমের কল্যান পার্টি ইতিমধ্যে নির্বাচনে অংশ নেবার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়াও, বিভিন্ন ইসলামী দল ও জোট ভোটে অংশ নিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র বারবারই অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছে। এই লক্ষ্যে বাইডেন প্রশাসন ভিসানীতি প্রণয়ন এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাধা দানকারীদের বিরুদ্ধে ভিসানীতি প্রয়োগ করেছে। অর্থাৎ সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে মার্কিন ভিসা দেয়া হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা কিংবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা যে কেউ এই ভিসানীতির আওতাভুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের দুই সংস্থা এনডিআই এবং আইআরআই সুষ্ঠু নির্বাচনের রোডম্যাপ দিয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে বিএনপির সমর্থক বলে সমালোচনা মুখর। র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং ভিসানীতির পর যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেয় কিনা এমন আশঙ্কা নিয়ে কানাঘুষা রয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কোনও বিদেশি চাপ মোকাবেলা করে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধ পরিকর। ভারত, চীন, রাশিয়াসহ অনেক দেশই নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করছে। আন্তর্জাতিক মহলের এই বিভক্তি শেখ হাসিনাকে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ মোকাবেলায় সহায়তা করছে।
নির্বাচন, রাজনীতির এমন ঢামাঢোলের মধ্যে অর্থনীতি নিয়ে বিশেষ করে ডলার সংকট এবং মুল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। ভোটের আগে আলোচনার লক্ষ্যে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ভারত সফরে গেছেন। রুশ মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত অক্টোবরের শেষ দিকে এক বিএনপি নেতার সঙ্গে বৈঠক করে সরকার বিরোধী সমাবেশ করতে সহায়তা করেছেন। এটা স্পষ্টত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ। রুশ যুদ্ধ জাহাজ বাংলাদেশে শুভেচ্ছা সফর করে গেছে।