ছয় দিনে ১২ জন নিহত
হরতাল-অবরোধে অচল বাংলাদেশ
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৩:১৩ এএম, ৪ নভেম্বর ২০২৩ শনিবার
অনড় অবস্থানে আ.লীগ-বিএনপি
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে -
হরতাল ও অবরোধে বাংলাদেশ এখন রীতিমত অচল। গত ২৮ অক্টোবর রাজধানী ঢাকায় ভয়াবহ সহিংসতার পরদিন দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতালেও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তারপর টানা ৭২ ঘন্টা অবরোধেও সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিএনপি ও তার শরিকরা নতুন করে আবারও রোববার ও সোমবার দুই দিনের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
গত ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতায় অন্তত ১২ জন মানুষ মারা গেছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির বহু নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। কারাগারগুলি উপচে পড়ছে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীর ভিড়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, নির্বাচন হবে এবং যথাসময়ে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘কারও চোখ রাঙানো কিংবা চোখ বাঁকানোর পরোয়া করি না’। দুই বড় দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপি’র অনড় অবস্থানের মধ্যে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশিরা তফসিল ঘোষণার আগেই দুই বড় দলের মধ্যে সংলাপ করে সংঘাত পরিহারের আহ্বান জানিয়েছেন। তারা শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিচ্ছেন। বিএনপি নেতারা চাইছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন।
নির্বাচনের দিনক্ষণ এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ ঘোলাটে হচ্ছে। নানা রকম ঘটনা প্রবাহ দেশে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। ২৮ অক্টোবর প্রকাশ্যে পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা, প্রধান বিচারপতির বাসভনের গেট ভেঙ্গে ঢুকে পড়া, সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং তার পরপরই পুলিশের টিয়ারসেলে বিএনপি’র জনসভা পন্ড হয়। ওই দিন নবম পদাতিক ডিভিশনের সাবেক জিওসি অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক মার্কিন নাগরিককে নিয়ে বিএনপি অফিসে হাজির হন। মিয়ান আরাফি ওরফে জাহিদুল ইসলাম বেল্লাল নামের ওই ব্যাক্তি নিজেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা বলে পরিচয় দেন। তিনি বলেছেন, পুলিশ বাহিনী ও আনসারের ওপর অবশ্যই স্যাংশন দেয়া হবে। কথিত ‘বাইডেনের উপদেষ্টা’র বক্তব্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুবই বিব্রত। তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস বলেছে, ওই ভদ্রলোক যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিনিধি নন। তিনি একজন বেসরকারী (মার্কিন) নাগরিক। এই ঘটনায় আরাফি ও সারওয়ার্দী উভয়ে গ্রেফতার হয়েছেন।
বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে বিএনপি’র ‘অবতার’ এবং ‘ভগবান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আওয়ামী লীগও সামাজিক মাধ্যমে পিটার হাসকে নিয়ে ট্রল করছে। যুক্তরাষ্ট্র এতটাই বিব্রত যে, তাদেরকে বারবারই বলতে হচ্ছে- আমরা কোনও দলের পক্ষে নই।
সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বেড়েছে। মার্কিন উপ সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আখতার বাংলাদেশ সফর করেছেন। জন কেরির সঙ্গে দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত সাবের হোসেন চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, যাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমান্তরালে কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্যে কাজে লাগানো হচ্ছে, তিনি মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে উভয়ে একমত হয়েছেন যে, নির্বাচনই ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র পথ।
সরকারি মহলের ধারণা, বাইডেন প্রশাসন তার দেশের মূল্যবোধের আলোকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে তারা চায় রাজনৈতিক আনুগত্য এবং অর্থনৈতিক, সামরিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বৃদ্ধিও কারণে চীন খুব জানতে চাইছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের গোপনে কিছু হচ্ছে কিনা যা চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)কে ক্ষতি করে।
জেল হত্যা দিবসকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসহ বেশ কিছু দাবি নিয়ে তাজ উদ্দিন আহমদের পুত্র সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ ও তার বোন শারমিন আহমেদ ১৪৪ ধারার মধ্যে গণভবনের সামনে অবস্থান ও মিছিল করেছেন। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) এবং জাতীয় সংসদে সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। দ্রুত ঘটে চলা বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের মধ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ একের পর এক বিএনপি’র শীর্ষ নেতারা গ্রেফতার হচ্ছেন।
যুদ্ধ ও বৈশি^ক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এমনিতেই খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে। তার ওপর উপর্যুপরি অবরোধে অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। হরতাল ও অবরোধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড প্রায় স্থবির। দূরপাল্লার বাস চলছে না। বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি অচলাবস্থার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সম্মেলনে অংশ নিতে সৌদি আরব সফরে যাচ্ছেন।
নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার জন্যে প্রথা মেনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করবে। তারপর তফসিল ঘোষণা করবে। শোনা যাচ্ছে, নভেম্বরের মাঝামাঝি তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠার পর তফসিল ঘোষণার প্রতি জোর দিচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে এটাই এখন সবার প্রশ্ন। কেউ কেউ মনে করেন, পরিস্থিতি ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’ এর দিকে যাচ্ছে। অনেকে আবার শেষ মূহূর্তের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাদের আশা, শেষ মূহূর্তে একটা সমাধানে আসবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুই বড় দলের অংশগ্রহণে সুন্দর নির্বাচন হবে। তবে এমন সমঝোতা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই মঙ্গল।
