বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন সংঘাত নাকি সমঝোতা
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৪৬ এএম, ২১ অক্টোবর ২০২৩ শনিবার
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনিশ্চয়তা ক্রমশঃ বাড়ছে। বিএনপিসহ রাজপথের বিরোধী দলগুলো দূর্গাপূজার বিরতির পর আগামী ২৮ অক্টোবর রাজধানী ঢাকায় বড় সমাবেশ ডেকেছে। তারপর থেকে তারা লাগাতার কর্মসূচি দিয়ে যাবে। এমন কি ঢাকামুখী পদযাত্রা কর্মসূচির কথাও বলছেন বিএনপি নেতারা। পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বিরোধী দলের কর্মসূচি মোকাবেলায় রাজপথে থাকার অঙ্গীকার করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা। যদিও গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ এমন কি কোনও কোনও রাজনৈতিক নেতাও গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রধান দুই দলের মধ্যে অর্থবহ সংলাপ করে সমঝোতায় পৌঁছানোর চাপ দিচ্ছেন। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচনের আগে সামনের দিনগুলো সংঘাতময় হয়ে উঠবে নাকি রাজনৈতিক সমঝোতা করা হবে এটি নিয়েই বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। এসব আলোচনায় আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকাও বিবেচিত হচ্ছে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে, দূর্গাপূজার দিনগুলো বাদ দিলে সরকার পতনের জন্য পর্যাপ্ত সময় নেই। ফলে শেষ পর্যন্ত সরকার পতন না হলে পরিস্থিতি কোনও দিকে মোড় নেবে এ নিয়ে কৌতূহলী জিজ্ঞাসা সাধারণ মানুষের মধ্যেও। বিএনপি নেতারা বলছেন, তারা শান্তিপূর্ণ পথে সরকার বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। কিন্তু রাজপথে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে তা সহিংস হয়ে ওঠার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। অন্যদিকে, সহিংসতা সৃষ্টি হলে বিরোধী দলের ওপর বলপ্রয়োগ করতে পারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। সংঘাতময় পরিস্থিতি যদিও কারও কাম্য নয়। তবে সংঘাতের রাজনীতি আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে বিএনপি’র জন্যে সেটা হিতে বিপরীত হতে পারে।
বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার আহ্বান জানাচ্ছে। সর্বশেষ মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আখতার বাংলাদেশ সফরকালে একই আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ভোটের দিনের পরিবেশ শুধু নয়; এই মাস থেকেই মিডিয়া ও সুশীল সমাজের জন্যে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে তারা মতপ্রকাশ করতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবারই প্রথম নয়। ২০১৪ সালে এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরেও নির্বাচনের গুণগত মান নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে এবার কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাইডেন প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্যে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে। দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গে বাইডেনের আলোচনায় নির্বাচনের বিষয়ে গুরুত্ব লাভ করেছে। বাইডেনের নির্দেশে তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলেভান ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসব দেখে অনুমিত হয়, যুক্তরাষ্ট্র কিছু একটা চাইছে যা স্পষ্ট নয়। এটা কি শুধুই অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন? এটা কোনও বিশ্লেষকই বিশ^াস করতে চান না। তাদের অনুমান, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে এমন একটি সরকার চায় যা তাদের প্রতি রাজনৈতিকভাবে অনুগত। সেটা একান্তই সম্ভব না হলে তাদেরকে বাণিজ্যিক সুবিধা দেবে এমন কেউ বাংলাদেশে ক্ষমতায় যাক।
বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ মহলের ধারণা, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিংবা বিএনপি আমলের শিক্ষামন্ত্রী ওসমান ফারুকের ভাই ওসমান সিদ্দিকী বাইডেন প্রশাসনকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছেন। ইউনূস ও ওসমান সিদ্দিকী উভয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক দলের ঘনিষ্ঠজন।
বাইডেন প্রশাসনের উদ্বেগের আরেকটি জায়গা হলো, শেখ হাসিনার সরকার ক্রমেই চীনপন্থী হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা যে কোনও সরকারকেই দেশের উন্নতি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হয়। শেখ হাসিনাকে চীনপন্থী মনে করে দূরে সরিয়ে অন্য যাকে বসানো হবে সেও যে চীনপন্থী হবে না তার কোনও গ্যারান্টি নেই। আরেকটি বিষয় হলো, বাংলাদেশে রিজিম চেঞ্জ করার মতো পয়েন্ট অব নো রিটার্নে যাওয়ার কোনও কর্মকান্ড বাইডেন প্রশাসনকে করতে দেখা যাচ্ছে না। কারণ রিজিম চেঞ্জ করার যে কোনও চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। এক্ষেত্রে, বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে প্রেস্টিজ ইস্যু হতে পারে।
এদিকে, শেখ হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকেও শোনা যাচ্ছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে সম্প্রতি বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে প্রস্তাব পাশ হয়েছে। ইউরোপীয় প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক মিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক, ইইউ বড় আকারের পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশে পাঠাবে না। এমন পরিস্থিতির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৪ অক্টোবর চার দিনের সফরে ব্রাসেলস যাচ্ছেন। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডেন লিয়েনের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী এই সফরে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী সেখানে গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামে অংশ নেবেন। আগামী ২৫ ও ২৬ অক্টোবর গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরাম ইইউ সদর দফতর ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানীর বিষয়ে বাংলাদেশকে আরও সম্পৃক্ত করার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এছাড়াও, সম্মেলনে আগাম ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনাও আসন্ন ব্রাসেলস সফরে হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে কোনও ঘাটতি থাকলে তা পূরণের চেষ্টা হতে পারে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তাপ-উত্তেজনার আশঙ্কার মধ্যে শেখ হাসিনার সরকার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধি করছেন। গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামে যোগদান হলো সেই প্রচেষ্টার অংশ। গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির মতো ইউরোপীয় কৌশল বলে মনে করা হয়। গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরাম শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন কিংবা কানেকটিভিটি জোরদার নয়; বরং ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ।
