বিদেশি সাহায্য কমছে প্রত্যাবাসনে নেই আশার আলো
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৩:৩৮ এএম, ২৬ আগস্ট ২০২৩ শনিবার
রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছর
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে -
রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছর অতিবাহিত হলেও সংকট সমাধানে কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। যদিও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত কিছু অগ্রগতি হয়েছে। মিয়ানমার বলছে, একটি পাইলট প্রকল্পের অধীনে ডিসেম্বরের মধ্যে সাত হাজার রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেবে। তবে পশ্চিমা বিশ্ব এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী মিয়ানমারে নিরাপদ পরিবেশ নেই বলে এ মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিরোধিতা করছে।
তবে এখন পর্যন্ত একজনকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। বরং রোহিঙ্গাদের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। জয়েন্ট রেসপন্স টিম চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক সাহায্যের জন্য আবেদন করেছিল। এর বিপরীতে আগস্ট পর্যন্ত সাহায্য মিলেছে মাত্র ২৮ শতাংশ। বৈদেশিক সহায়তা কী পরিমাণ কমেছে, এ থেকে সহজেই অনুমেয়।
এদিকে দিন যতই যাচ্ছে, ক্যাম্পে বাড়ছে রোহিঙ্গা শিশু জন্মের হার। ছয় বছরে ক্যাম্পে প্রায় দেড় লাখ শিশু জন্ম নিয়েছে বলে দাবি করেন ক্যাম্প ম্যানেজমেন্ট সংশ্লিষ্টরা।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের খাবারের খরচও কমিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) আগে একজন রোহিঙ্গার জন্য খাবার খরচ বাবদ মাসে ১২ ডলার দিয়েছে। মার্চে তা কমিয়ে করা হয়েছে ১০ ডলার। জুনে আরও কমিয়ে আট ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দাতাই সাহায্য কমিয়ে দিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অবশ্য দেশগুলোকে রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা রোহিঙ্গাদের কাজ দেওয়ার জন্য দাবি করছে।
কিন্তু বাংলাদেশ সরকার মনে করে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে কাজ দিলে প্রত্যাবাসন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহ দেখাবে না। তবে বাংলাদেশ সরকার অবশ্য রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের ভেতরে কাজ করার অনুমতি দিচ্ছে। এছাড়া উখিয়া-টেকনাফ ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ঘনত্ব কমাতে নোয়াখালীর ভাসানচরে আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা স্থানান্তর করা হয়েছে। সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গার আবাস গড়া হয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
এদিকে রোহিঙ্গারা তুচ্ছ ঘটনায় খুনোখুনি ছাড়াও মাদকের ব্যবসা, অপহরণ ও ধর্ষণের মতো নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। ছয় বছরে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহসহ ১৩১টি হত্যাকান্ডের ঘটনায় মামলা হয়েছে।
তবে বিভিন্ন সংস্থা ও বেসরকারি তথ্যমতে ছয় বছরে ক্যাম্পে দুই শতাধিক হত্যাকান্ড ঘটেছে। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দিতে গিয়ে প্রায় আট হাজার একরের বেশি বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। বিপর্যয় ঘটেছে পরিবেশের। এ কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে পাহাড়ধসের ঘটনাও। এতে প্রাণহানিও ঘটছে প্রতিবছর।
মিয়ানমারের একটি সীমান্ত চৌকিতে হামলার অজুহাতে রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থি বৌদ্ধরা নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন শুরু করলে ২০১৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর রোহিঙ্গা ঢল বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বর্তমানে কক্সবাজারে অবস্থিত দুটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত ভাসানচরে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। মিয়ানমারের বর্তমান সামরিক জান্তা আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে থাকায় পাইলট প্রকল্পের অধীনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য কিছুটা আগ্রহ দেখাচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সহায়তার মাধ্যমে পদক্ষেপের চিন্তা করা হলেও পশ্চিমারা মনে করে, মিয়ানমারে সামরিক জান্তার পতন হলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান সহজ হবে। যদিও অং সান সু চি’র নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আগ্রহ দেখায়নি। তাছাড়া চীন ও রাশিয়ার ভেটোর আশঙ্কায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাইকমিশন রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত নিষ্ঠুরতাকে জাতিগত নিধন বলে অভিহিত করেছে। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (আইসিজে) রাষ্ট্র হিসাবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে (আইসিসি) দমন-পীড়নে অংশ নেওয়া মিয়ানমারের সেনা ও বেসামরিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা মামলার কাজও চলছে।
