জাতীয় শোক দিবসের স্মরণসভা
হাসিনার বক্তব্যে আলোড়ন
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৪৯ এএম, ১৯ আগস্ট ২০২৩ শনিবার
তাদের উদ্দেশ্য নির্বাচন বা গণতন্ত্র নয়
বঙ্গোপসাগর ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে
আক্রমণ করা কারও কারও উদ্দেশ্য
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে -
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে আলোড়ন উঠেছে। কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাদের উদ্দেশ্য নির্বাচন বা গণতন্ত্র নয়। উদ্দেশ্য হলোÑ দেশের উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা। বঙ্গোপসাগরকে ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে আক্রমণ করা, এটাই কারও কারও উদ্দেশ্য। আমাকে সরিয়ে তাদের কিছু পদলেহনকারী গোলামদের ক্ষমতায় বসিয়ে ভারত মহাসাগরের মধ্যে থাকা দেশগুলোয় হামলা ও অশান্তি সৃষ্টি করে কীভাবে ধ্বংস করা যায়, সেই উদ্দেশ্য নিয়েই তাদের এত টালবাহানা। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা পছন্দ করে না বলেই তারা নির্বাচন নিয়ে খুব বেশি উতলা। আমাদের দেশপ্রেমিক জনগণকে এসব বুঝতে হবে, সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। আমি তো বলব, ভারত মহাসাগরের অন্য দেশগুলো এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন আছে, সেটা আমি বিশ্বাস করি।
গণতন্ত্রের নামে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরসহ এ অঞ্চলের সমুদ্রসীমা নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্যকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, দেশ ও জনগণের ভবিষ্যৎ স্বার্থ মাথায় রেখে এ বিষয়ে দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে আরও সবিস্তারে তথ্যভিত্তিক কথা বলা প্রয়োজন।
গত বুধবার বিকালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ সময় কোনো খেলা খেলে জনগণের ভাগ্য কেউ যাতে কেড়ে না নিতে পারে, সেজন্য দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, শত ব্যথা-বেদনা মুখ বুজে সহ্য করে দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছি। কতবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। যতক্ষণ বেঁচে আছি, ততক্ষণ দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেব না। দেশের মানুষের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় থাকার লোভ আমার বাবারও কোনোদিন ছিল না, আমারও নেই।
ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে ভারত মহাসাগর, অপরদিকে প্রশান্ত মহাসাগর-এই ভারত মহাসাগরেই কিন্তু আমাদের ‘বে অব বেঙ্গল’। এর গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রাচীনকাল থেকে এই জায়গা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চলে আসছে। আমাদের ভারত মহাসাগরে যত দেশ আছে, কারও সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব নাই, সম্পূর্ণ নিষ্কণ্টক একটা যোগাযোগ পথ। এই জলপথে আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে নির্বিঘেœ পণ্য পরিবহণ হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা আমি জানি, আমি বুঝি, আমাকে ক্ষমতা থেকে সরাবে আর তাদের কিছু কেনা গোলাম আছে, পদলেহনকারী আছে, তাদের বসিয়ে এই জায়গাটাকে নিয়ে খেলবে। এটাই হচ্ছে তাদের প্রচেষ্টা, সেটা আমি ভালোভাবে বুঝতে পারি। আমাদের কিছু আঁতেল আছে, জানি না তারা এসব চিন্তা করে কি না। সেগুলো না করেই তারা এদের সঙ্গে সুর মেলায়। দুটো পয়সার লোভে তারা নানাভাবে এ কাজগুলো করে বেড়ায়।
চক্রান্তের বিষয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের যেমন সজাগ থাকতে হবে, তাছাড়া অন্যান্য দেশ, আমি তো বলবÑভারত মহাসাগরের অন্য দেশগুলো এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন আছে, সেটা আমি বিশ্বাস করি। দেশবাসীকেও বলব, যারা দেশপ্রেমিক, তাদের সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের এতটুকু ক্ষতি করে কোনোদিন ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা করি না।
এদিকে, ভারত মহাসাগরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, জনস্বার্থে এ বিষয়ে দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে আরও তথ্য উপাত্ত পাওয়া দরকার।
এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন মঙ্গলবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশের সামনে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে’ বলে মন্তব্য করেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, ভারত মহাসাগর যারা নিয়ন্ত্রণ করবে আগামী দিনে বিশ্ব তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে। এজন্য এবার বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অতি আগ্রহের কারণ ভূ-রাজনৈতিক। যুক্তরাষ্ট্র ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে চায়। কারণ প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও মিয়ানমারের মাধ্যমে রাশিয়ার উপস্থিতি নিয়ে তারা চিন্তিত। এমন কি ভারতও যুক্তরাষ্ট্রের এত বেশি মিত্র নয়, যতটা তারা চায়। এ কারণে বাংলাদেশে একটা পুতুল সরকার হলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুবিধা হয়।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের কেন্দ্রে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী দেশ। তাই ভারত মহাসাগরীয় দেশে এই স্ট্র্যাটেজি কার্যকর করতে বাংলাদেশকে প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের। এটিই আসলে তাদের মূল্য উদ্দেশ্য। নির্বাচন সুষ্ঠু করার কথা একটা বাহানা মাত্র।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, প্রধানমন্ত্রী যে অভিযোগ করেছেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি আমাদের জাতীয় স্বার্থের বড় একটি ইস্যু। এ বিষয়ে দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে জাতির সামনে আরও বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা দরকার।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত শমশের মবিন চৌধুরী বলেন, নির্ভরযোগ্য নয়, এমন সূত্রের ওপর ভিত্তি করে বারবার একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। কংগ্রেসে টম ল্যান্টন কমিশন আরও স্যাংশন দিতে বলছে। দুজন কংগ্রেসম্যান এসে ঘুরে গেলেন। তারা সুশীল সমাজ বলে যাদের সঙ্গে বৈঠক করলেন সবাই এক ঘরানার, সরকারবিরোধী লোকজন। যদিও তারা সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে, চাপ সৃষ্টি না করে নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য সহায়তা করা। এদিকে এ বিষয়ে আরও কয়েকজন কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এরমধ্যে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকও রয়েছেন।
