মঙ্গলবার   ১৮ নভেম্বর ২০২৫   অগ্রাহায়ণ ৪ ১৪৩২   ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

ধুঁকছে টাঙ্গুয়ার হাওর

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:০১ এএম, ১৬ আগস্ট ২০২৩ বুধবার

বড় ইঞ্জিন নৌকা ও হাউজবোটের অবাধ চলাচলে এবং পর্যটকদের নানা কর্মকাণ্ডে ঝুঁকির মুখে হাওরের জীববৈচিত্র্য

দেশের অনন্য সম্পদ টাঙ্গুয়ার হাওর মৎস্য ও জীববৈচিত্র্যের আধার। এই হাওরকে  বলা হয় ‘মাদার ফিশারিজ’। কিন্তু  বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এই হাওর তিলে তিলে নিঃশেষ হতে চলেছে। ইদানীং পর্যটনের নামে দিন-রাত হাওর জুড়ে অসংখ্য বড় ইঞ্জিন নৌকা ও বিলাসবহুল ‘হাউজবোট’ চলাচল করছে। এতে নতুন করে ঝুঁকির মুখে পড়েছে হাওরের পরিবেশ ও প্রতিবেশ। কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই হাউজবোটগুলো প্রতিদিন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা হাওর। এতে ধ্বংস হচ্ছে মাছের অনন্য এই অভায়াশ্রম।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. মৃত্যুঞ্জয় কুণ্ড বলেন, মাছের প্রজননের সময় হাওরে ইঞ্জিন নৌকার শব্দে মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হয়। এতে মাছের বংশ বৃদ্ধি হয় না। তিনি বলেন, এতে কৃষি ও মৎস্য সম্পদের পাশাপাশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে উদ্ভিদের ওপরও।

জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, পর্যটনকে উত্সাহিত করতে প্রচলিত আইনকানুনের আলোকে  গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। তা বাস্তবায়িত হলে হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে পরিকল্পিত পর্যটন করা সম্ভব হবে।

সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ‘ছয়কুড়ি বিল, নয়কুড়ি কান্দা’র টাঙ্গুয়ার হাওর ৩৪ হাজার ৫৮০ একরের বেশি আয়াতনের। টাঙ্গুয়ায় হেমন্তে ২৪ হাজার ২৫ একর জমিতে পানি থাকে। বিশাল আয়তনের টাঙ্গুয়ার হাওরকে ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি ‘রামসার সাইট’ ঘোষণা করা হলে এর সঠিক পরিচর্যা নেই।

‘টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে’ মন্তব্য করে স্থানীয় বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, টাঙ্গুয়ায় প্রকৃতি-পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং মাছের উৎপাদন বাড়াতে কমিউনিটিভিত্তিক ব্যবস্থাপনা ব্যর্থ। এটি বাতিল করে হাওরের সম্পদ রক্ষায় প্রয়োজনে ইজারা প্রথায় যেতে হবে। ইদানীং টাঙ্গুয়ায় পর্যটন ব্যবসাকে ঘিরে এলাকায় কিছুটা কর্মসংস্থান হলেও অস্তিত্ব হারাতে বসেছে হাওরটি। বিশেষ করে ইঞ্জিন নৌকা ও হাউজবোটের অবাধ যাতায়াত এবং পর্যটকদের নানা কর্মকাণ্ডে টাঙ্গুয়া এখন মরতে বসেছে।

হাউজবোটগুলোর অতিরিক্ত ভাড়া ও বোটে নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ। রাজধানী ঢাকা বা ভিন্ন জেলার পর্যটন ব্যবসায়ীরা আধুনিক সুবিধা সংবলিত ‘হাউজবোর্ড’ নির্মাণ করে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছেন। এতে স্থানীয় মাঝিরা যেমন কর্মহীন হয়ে পড়ছেন; বিলাসবহুল হাউজবোটগুলো হাওরের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ইঞ্জিন নৌকা ও হাউজবোটে করে উচ্চ শব্দের সাউন্ড বক্স বাজিয়ে  চলেন হাওরে। কিন্তু ব্যবহৃত পানির বোতল, প্লাস্টিকের পণ্য আর মলমূত্র পানিতে ফেলায়, নৌকার কালো ধোঁয়া ও কেরোসিন মবিল হাওরের বদ্ধ পানি দূষিত করছে। ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় নৌকাগুলো করচগাছে বেঁধে রাখার কারণে শতাধিক হিজল-করচগাছের ডালপালা ও স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তাহিরপুর নৌচালক মালিক সমিতির সভাপতি শাহীনুর তালুকদার বলেন, ‘আমরা স্থানীয়রা নিয়মনীতি অনুসরণ করে চলাচল করলেও বাইরের নৌকা ও হাউজবোট নিয়ন্ত্রণহীনভাবে হাওরে চলাচল করে।’

১৯৯৯ সালে সরকার এই এলাকাকে বিপন্ন প্রতিবেশ এলাকা এবং ২০০০ সালে ইউনেসকো রামসার এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। হাওরটি বিরল প্রজাতির মাছ ও অতিথি পাখির স্বর্গরাজ্য ছিল। কিন্তু এর অস্তিত্ব এখন হুমকির সম্মুখীন। ২৬ প্রজাতির প্রাণির আবাসস্থল হাওরটির পরিচর্যা ও তদারকির অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।