অনিবার্য সহিংসতার পথে এগোচ্ছে বাংলাদেশ
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৩৭ এএম, ৫ আগস্ট ২০২৩ শনিবার
দেশে-প্রবাসে বাড়ছে উদ্বেগ উৎকন্ঠা
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে-
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফের সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানের কারণে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। সম্প্রতি এমন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সহিংস ঘটনা ঘটেছে। বিএনপি নেতা গয়েশ^র রায়, আমান উল্লাহ আমানসহ অনেকে আহত হয়েছেন। পুলিশ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বিএনপি একদফা আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি আদায়ে কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে। বিএনপি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন চায়। আওয়ামী লীগ সংবিধানের অধীনে নির্বাচন করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোতে আগামী নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনেই করতে হবে।
বিএনপি’র কর্মসূচি চলাকালে আওয়ামী লীগও মাঠ ছাড়তে নারাজ। আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকছে। শোকের মাস আগস্টে আওয়ামী লীগ কর্মসূচির ধরনে পরিবর্তন আনছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তারপর থেকে আওয়ামী লীগ পুরো আগস্ট মাসকে শোকের মাস হিসাবে পালন করে। এই মাসে সাধারণত স্মরণ সভা, মিলাদ-মাহফিল, কাঙ্গালীভোজ ধরনের কর্মসূচি পালন করে আওয়ামী লীগ। রাজনীতি উত্তপ্ত হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিলেও শোকের মাসে সংযত থাকবে আওয়ামী লীগ। আগস্টে তাই শোকের কর্মসূচি বেশি থাকবে বলে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী মহল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার বাইরে রংপুরে জনসভা করেছেন। উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়েছেন।
বিএনপি’র কর্মসূচিতেও কিছুটা পরিবর্তন আসছে। বিএনপি বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের জন্যে রাজধানী ঢাকাকে প্রাধান্য দিয়েছিল। আন্দোলনের মাঠে ওয়ার্মআপ কর্মসূচি হিসাবে ঢাকাকে বেছে নিয়েছিল। বিএনপি’র নেতাকর্মীরা ওয়ার্মআপ কর্মসূচিতে খুশি। তারা মনে করছেন, তাদের কর্মসূচি সফল হয়েছে। তবে নতুন কৌশলে তৃণমূলকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। ঢাকায় কর্মসূচি পালনে সারাদেশ থেকে যেভাবে নেতাকর্মীরা নীরবে জড়ো হয়েছেন এখন একইভাবে রাজধানী ও আশেপাশের অঞ্চল থেকে থেকে কর্মীরা গোপনে ছোট জোট দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় যাচ্ছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও গোয়েন্দা জাল বিস্তার করেছে। কোনও গ্রুপ কোথাও যাচ্ছে বলে খবর পেলে সেখানে আগে আগেই পুলিশ হাজির থাকছে। জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কোন জেলার বাসিন্দা তা নিশ্চিত হতে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখতে চাইছে। বিএনপি কর্মীরাও নানান কৌশল নিচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন তারা পিকনিক করতে এসেছেন, ইত্যাদি। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় (বুয়েট) এর ২৫ জন ছাত্রকে টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তারা দেশে ‘অস্থিতিশীল’ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে এমনই ছিল আশঙ্কা। গ্রেফতারের পর অভিভাবকরা সংবাদ সম্মেলন করে তাদের সন্তানদের নির্দোষ বলে দাবি করে। বুয়েটের ওই ছাত্ররা অবশ্য জামিনে মুক্ত হয়েছেন।
বিএনপি’র সরকারবিরোধী আন্দোলন সামনে রেখে পুলিশে বদলীর ক্ষেত্রে খুবই যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা ও তার পাশর্^বর্তী জেলাগুলোতে পুলিশের যে কোনও পর্যায়ের কর্মকর্তাকে পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রে তার ও তার পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় খোঁজ নেয়া হচ্ছে। ফলে একটা গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
বিএনপি’র কর্মসূচি চলাকালে সহিংস ঘটনায় জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য অনেক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিরোধী নেতাকর্মীদের হয়রানি, ভয়ভীতি দেখানো থেকে বিরত থাকার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। মার্কিন ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আনছে। বিএনপি ও জামায়াতকে মাঠে কর্মসূচি পালন ভিসা নীতির আগে কঠিন ছিল। তাছাড়া, বিএনপি’র পূর্বের কর্মসূচির সময় গয়েশ^র রায় ও আমান উল্লাহ আমান আহত হওয়ার পর সরকারের দিক থেকে নাটকীয় নমনীয় আচরণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ঘটনা। গয়েশ^র রায়কে পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান হারুনুর রশিদ পাঁচ তারকা হোটেল থেকে খাবার এনে ‘জামাই আদর’ করে আপ্যায়ন করা এবং আমানকে প্রধানমন্ত্রীর ফুল পাঠানোর ঘটনা বেশ আলোচিত হয়েছে। অপরদিকে, ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কর্মকান্ডকে সরকারী মহলে বিএনপির পক্ষে কাজ করার অভিযোগ ওঠে। তারপর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া সফর করে সেখানে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেন। বৃহস্পতিবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে মতবিনিময় করেন।
এদিকে, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে মামলাও সক্রিয় হচ্ছে। সর্বশেষ বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী জোবায়দা রহমানকে সাজা দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।
সাধারণ মানুষের একটাই জিজ্ঞাসা, দেশে কী হচ্ছে। এ বিষয়ে কারও কাছে কোনও সঠিক উত্তর নেই। কেউ কেউ বলছেন, ২০১৪ সাল কিংবা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন এবার হচ্ছে না। তবে সবার মনেই সহিংসতা নিয়ে উৎকন্ঠা বেশি। রাজনৈতিক সমঝোতার জন্যে সংলাপ করতে কেউ কেউ আহ্বান জানাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে, অর্থবহ সংলাপ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। অনিবার্য সহিংস পরিস্থিতির পথেই অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ।
