মঙ্গলবার   ১৮ নভেম্বর ২০২৫   অগ্রাহায়ণ ৪ ১৪৩২   ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

অসীম সাহসী এক কন্যার লড়াই

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৩:৩৭ এএম, ২৯ জুলাই ২০২৩ শনিবার


 
আজকাল ডেস্ক-
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টার থেকে ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নিখোঁজ হন অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ। এরপর আবাসিক কোয়ার্টারের পেছনের ম্যানহোল থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। বাবা নিখোঁজ, লাশ উদ্ধার এবং দীর্ঘ আইনি লড়াইসহ দুঃসহ সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করেছেন মেয়ে অদম্য সাহসী শেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ।
মা সুলতানা আহমেদ আর ভাই সানজিদ আলভি আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে কীভাবে বিভীষিকাময় সেই ১৭টি বছর অতিক্রম করেছেন শেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ এবং তার পরিবারের সদস্যরাÑ সেটি বর্ণনা করেছেন। শেগুফতা তাবাসসুম বলেন, বাবার হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় হয়েছে, এখন নেব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।
তিনি বলেন, লাশ উদ্ধারের পরই ভাই সানজিদ আলভি আহমেদের ফোনে জানতে পারি বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। তখন আমি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে আইন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। মুহূর্তের মধ্যেই শক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। বাবার হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আমি মনস্থির করে ফেলি, আইন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা অব্যাহত রাখব। হত্যাকারী যারাই হোক, আদালত এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে তাদের পরিচয় উদ্ঘাটন করব। নিজেকে আইনজীবী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করব। চালিয়ে যাব আইনি লড়াই।
শেগুফতা বলেন, বাবার লাশ উদ্ধারের পর ভাই সানজিদ আলভি আহমেদ মতিহার থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন। মামলা দায়েরের ক্ষেত্রেও বাধা আসে। আসে রাজনৈতিকভাবেও নানান প্রতিবন্ধকতা। এমনকি মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে পুলিশের কিছু কর্মকর্তাও আমাদের নিরুৎসাহিত করেন। সর্বশেষ সে সময়ের রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনার নাঈম আহমেদের নির্দেশে মামলাটি রুজু হয়। রাজশাহী বিশেষ জজ আদালতে মামলাটির কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর সেটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরিত হয়। মামলাটি স্থানান্তর করতে আমাদের অনেক বেগ পোহাতে হয়েছে। এ সময় মামলার তারিখগুলোতে আমার ভাই সানজিদ আলভি আহমেদ ঢাকা থেকে রাজশাহী যাতায়াত করতেন। সে সময় রাজশাহীতে জামায়াত-শিবিরের চরম দাপট ছিল। জামায়াত-শিবির কর্মীরা এ সময় আমার ভাইকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখাতেন। তাকে বেশ কয়েকবার প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়।  
ড. তাহেরের মেয়ে বলেন, রাজশাহীতে আমাদের আইনি লড়াইয়ে সহযোগিতা করেছিলেন প্রবীণ আইনজীবী ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপু। তিনি পরে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সহযোগিতা করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাবিবুর রহমানের সহধর্মিণী মর্জিনা বেগম। মামলাটি ছিল স্পর্শকাতর। এ কারণে অনেক আইনজীবী পাশে দাঁড়াতে চাইলেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে সেটি তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
শেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ বলেন, ২০১১ সালে মামলাটি হাইকোর্টে চলে আসে। এর আগে ২০০৯ সালে আমার অনার্স শেষ হয়ে যায়। নিম্ন আদালত থেকেই আমি মায়ের আদালতে উপস্থাপিত বক্তব্যগুলো তৈরি করে দিতাম। মামলার বিষয়ে আমি সব সময় মা ও ভাইকে সহযোগিতা করতাম। হাইকোর্টে মামলা চলে আসার পর থেকেই আদালতে আমার দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। সেই সকালে বেরিয়ে সারাদিন খেয়ে না খেয়ে আদালতে উপস্থিত থেকেছি। বাবার মামলার কৌঁসুলিদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছি। ছোট বয়সেই অনেক চ্যালেঞ্জিং এবং কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এ সময় আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক। এছাড়া অন্য শিক্ষকরাও আইনি বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন।
শেগুফতা বলেন, ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে ১৭টি বছর পার করেছি। বাবাকে হত্যার পর আমাদের পরিবারে একমাত্র উপার্জন করেন আমার ভাই। আমি উচ্চশিক্ষা নিলেও বাবার মামলার লড়াই চালিয়ে যেতে কোনো চাকরি করতে পারিনি। কোনো সময় নিজের কথা চিন্তা করিনি। সব সময় মামলার ব্যাপারেই ব্যস্ত থেকেছি। এখনো বিয়ে করিনি। আসামিদের ফাঁসির রায় হয়েছে। এখন আমি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। আমার অদম্য জেদ আর দৃঢ় মানসিকতার কারণেই বিজয়ী হয়েছি। মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি দীর্ঘ সময়ে আমাদের পরিবারের সদস্যদের পাশে যারা দাঁড়িয়েছেন।