মঙ্গলবার   ১৮ নভেম্বর ২০২৫   অগ্রাহায়ণ ৪ ১৪৩২   ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

৮০২ কোটির নিষ্ফল গবেষণা

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৬:৩১ পিএম, ১৮ জুলাই ২০২৩ মঙ্গলবার

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের গবেষক দল বাংলাদেশে ক্ষুরা রোগ প্রতিরোধে কার্যকর টিকা উদ্ভাবন করেন। ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর এ উদ্ভাবনের জন্য পেটেন্ট, ডিজাইনস ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরে পেটেন্টের জন্য আবেদন করা হয়। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে অধিদপ্তরে যথাক্রমে ১৯টি ও আটটি পেটেন্ট গৃহীত হয়। কিন্তু গবাদি পশুর টিকা-সংক্রান্ত উদ্ভাবনটি ওই দুই বছরে পেটেন্টের জন্য নিবন্ধিত হয়নি। প্রকল্পের এসপিএম-সূত্র বলেছে, পেটেন্ট-আবেদনটি হিমঘরে চলে গেছে।

শুধু ঢাবি নয়, এমন ঘটনা ঘটেছে বেশ কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার ক্ষেত্রে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সাতটি গবেষণা পেটেন্টের জন্য আবেদন করেছিল। একটি আবেদনও গ্রহণ করেনি পেটেন্ট অধিদপ্তর। জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের অবহেলা ও অধিদপ্তর-কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে গবেষণা প্রকল্পগুলো সাফল্য পায়নি। পেটেন্ট অধিদপ্তরের অবহেলায় গবেষণা কার্যক্রম আলোর মুখ দেখে না। সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিতে পারলে গবেষণাগুলো বিশ্বমানের হতো বলে সংশ্লিষ্ট গবেষকদের বিশ্বাস। প্রকল্পটিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য ‘প্রোমোটিং অ্যাকাডেমিক ইনোভেশন’ নামের উপ-প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৮০২ কোটি টাকা। কিন্তু অনেক শিক্ষক গবেষণা করেননি, আবার যারা করেছেন তারাও পেটেন্ট অনুমোদন পাননি। সব মিলিয়ে ৮০২ কোটি টাকার ফল শূন্য।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হকের নেতৃত্বে একটি দল ক্যানসার শনাক্তের সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। এটি কার্যকর করা হলে মাত্র ৫০০ টাকায় দেশেই ক্যানসার শনাক্ত করা যেত। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ২৭টি গৃহীত আবেদনের মধ্যে এটি নেই। অর্থাৎ এর পেটেন্ট-আবেদনটিও গৃহীত হয়নি।

গরুর ক্ষুরা রোগের টিকা উদ্ভাবনকারী বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন এখন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি)। তার পেটেন্ট-আবেদন হিমঘরে কেন জানতে চাইলে দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে ইলেকট্রনিক পেটেন্ট দেখার মানুষ নাকি তাদের আছে অথচ পেটেন্ট অফিসে বিরাট লাইন। বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান এখানে পেটেন্ট জমা দেয়। একটা পেটেন্ট অনুমোদন পেতে তিন-চার বছর লাগে। ক্ষুরা রোগের টিকার পেটেন্ট রিভিউতেই পাঠানো হয়নি। তাদের নাকি রিভিউ করার মানুষ নেই।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলে সব মহলই। কিন্তু গবেষণায় বিনিয়োগ করেও সুফল পাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগকৃত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য গবেষণা নেই। আর অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার জন্য বরাদ্দই পায় না।

পেটেন্ট আবেদন কেন গৃহীত হয় না এ প্রশ্নের জবাবে সাবেক প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক গৌরাঙ্গ চন্দ্র মহান্ত দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যারা গবেষণার দায়িত্বে ছিলেন তারা গবেষণা করেছেন। গবেষণার পেটেন্ট আবেদনের জন্য টাকা-পয়সা লাগে। আমরা তাদের প্রাথমিক গবেষণায় টাকা দিয়েছি। বাংলাদেশে টাকা দিতে পারলে গবেষণা চলবে, না দিতে পারলে গবেষণা বন্ধ।’

তিনি বলেন, ‘এ রকম ঘটনা বিরল। প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পর চুলচেরা বিশ্লেষণধর্মী রিপোর্টও করেছে বিশ্বব্যাংক। তারা সন্তুষ্ট। আইএমইডি যথাস্থানে না গিয়েই প্রতিবেদন তৈরি করেছে।’

পেটেন্ট-আবেদন কেন গৃহীত হয় না এ প্রসঙ্গে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের সহকারী রেজিস্ট্রার মো. হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাধারণত ফার্মাসিউটিক্যালসের বিষয়গুলো পেটেন্টের আওতায় আসে না। আমাদের নতুন পেটেন্ট আইন হয়েছে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে। আগের আইনে যে ব্যবস্থা নিতাম, এখনকার আইনে সে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এখানে পেটেন্ট আবেদনের পর ১৮ মাস রেখে দিতে হয়। ১৮ মাস পর আমরা সেটি ওয়েবসাইটে পাবলিশ করি। প্রকাশের পর যে কেউ এটাতে মতামত দিতে পারে। আমরা তিন মাস অপেক্ষা করি। এরপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আবার আবেদন করতে হয়। তা না করলে আমরা শুরু করতে পারি না। অনেকেই এ প্রক্রিয়াগুলো জানেন না।’

তিনি বলেন, ‘আইনে বলা আছে, আবেদনের পর আমরা ৩৬ মাস অপেক্ষা করব। এর পরও যদি সংশ্লিষ্টরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আবেদন না করেন, তাহলে সেটিকে স্থগিত করব।’

দক্ষ জনবলের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ২০০৯ সালে হায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহেন্সমেন্ট প্রজেক্ট (হেকেপ) প্রকল্প হাতে নেয়। এটি শেষ হয়েছে ২০১৯ সালে। বিভিন্ন মেয়াদে এর ব্যয় ৬৮১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা হয়। এটিতে বিশ^ব্যাংকের অর্থায়ন ছিল ১ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা।

মূলত গবেষণা ও উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে হাতে নেওয়া এ প্রকল্পে কিছু গবেষণা হলেও উল্লেখযোগ্য গবেষণা নেই বলে মত দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ।

এ প্রকল্পের আওতায় গবেষণায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় (আট কোটি) করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের প্রকাশনা ছিল ২ হাজার ৫১৭টি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রকাশনাও হয়নি। প্রকাশনায় পিছিয়ে আছে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলোর প্রকাশনা সংখ্যা এক থেকে সাতের মধ্যে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ২৫টির গবেষণা খাতে এক টাকাও বরাদ্দ রাখা হয়নি। বিপরীতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে বরাদ্দ ও প্রকাশনা বেশি ছিল।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিধারী শিক্ষকের সংখ্যা কম থাকায় এবং মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কায় ইউজিসি এখনো কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করার অনুমতি দেয়নি। অনেক দেশে পিএইচডির মান বজায় রাখতে পিএইচডি থিসিস বাইরের বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হয়। ইউজিসি এ ব্যাপারে নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে বলে মনে করে আইএমইডি। তারা পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি ভালো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর অনুমতি দিতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কেউ বরাদ্দ পায় আবার কেউ পায় না এর কারণ কী? এ প্রশ্নের জবাবে গৌরাঙ্গ চন্দ্র মহান্ত বলেন, ‘আমরা কিছু নীতিমালা করেছিলাম। নীতিমালা করে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণার জন্য আবেদন করার বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছি। যারা আবেদন করেছে তারা বরাদ্দ পেয়েছে।’

২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের কোনো নথি সংরক্ষণ করেনি ইউজিসি। প্রকল্পের কোথায় কোন কাজ বাস্তবায়িত হলো তার কোনো তথ্যই নেই তাদের কাছে। আইএমইডি তাদের প্রতিবেদনে বলছে, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টের এসপিএম ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার অদক্ষতা, প্রকল্পে শেষে নথিপত্র সংরক্ষণ না করা, গবেষণা ও উদ্ভাবনকে এত গুরুত্ব দেওয়ার পরও একটি পেটেন্টও গৃহীত না হওয়া এ প্রকল্পের সবচেয়ে দুর্বল দিক।

এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেসব গবেষণা করবে দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো সেগুলো কাজে লাগাবে। কিন্তু ‘ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া লিংকেজ’ নামের এ উপ-প্রকল্পের আওতায় কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানই আগ্রহ দেখায়নি। অথচ এর আওতায় ১০টি ইনোভেশন ফান্ড বরাদ্দ ছিল।

আইমএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইন্ডাস্ট্রির পক্ষ থেকে কোনো অর্থ বরাদ্দ ছিল না কিংবা প্রকল্প শেষে উদ্ভাবনটির টেকসইকরণে কোনো অগ্রগতি ছিল না। ১০টির মধ্যে ছয়টির গবেষণা ফান্ডের অপ্রতুলতায় কাজ আর এগিয়ে নেওয়া হয়নি। সংস্থাটি বলেছে, ভবিষ্যতে মানসম্মত গবেষণা না হলে প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।

প্রকল্পের আওতায় কেন্দ্রীয়ভাবে গবেষণা ও উদ্ভাবনবিষয়ক তথ্য সংরক্ষণের জন্য হায়ার এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বা হেমিস নামে একটি তথ্য-ব্যবস্থাপনা ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়, যাতে শিক্ষার্থীরা বা গবেষকরা শর্তসাপেক্ষে নিজেদের গবেষণা সেখানে সংরক্ষণ করতে পারেন। কিন্তু প্রকল্প-শেষে সেটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জানা গেছে, এ ওয়েবসাইটের এসএসএল সার্টিফিকেট নেই।

বাংলাদেশের অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে বিশ্বমানের ইলেকট্রনিক তথ্য, বিশ^মানের ই-বুক, জার্নাল, গবেষণা প্রবন্ধ প্রভৃতির প্রাপ্যতার জন্য ইউনিভার্সিটি ডিজিটাল লাইব্রেরি (ইউডিএল) নামে একটি অনলাইন চালু করা হয়েছিল। উইলি অনলাইনে প্রায় ১ হাজার ৫০০ জার্নাল ও ১৮ হাজার ই-বুক ও অন্য রিসোর্স মজুদ থাকলেও চালুকৃত ইউডিএলে মাত্র ৩ হাজার ৫০০ ই-বুকের পাওয়া যায়।

৭৯ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার্থী মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নতুন ই-বুকে, জার্নালে এক্সেসের ক্ষেত্রে অনেক বাধা। প্রায়ই তারা কোনো বই খুঁজে পায় না।

বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন নেটওয়ার্ক (বিডিরেন) নামের একটি উদ্যোগ চালু করা হয়েছিল। সেটি লাভজনক অবস্থায় রয়েছে বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জসিম উদ্দিন বলেন, ‘হেকেপ প্রকল্পের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু মান বাড়েনি। মান বাড়ানোর পাশাপাশি এটির সম্প্রসারণও জরুরি।’

চুয়েটের শিক্ষার্থী তন্ময় দে জানান, হেকেপ প্রকল্পের কারণে রিনিউয়েবল এনার্জি নিয়ে ধারণা পেয়েছেন তিনি। তবে প্রকল্পটির বর্তমান অবস্থা আশানুরূপ নয়। যে ডিজিটাল লাইব্রেরি করা হয়েছে তাতে সন্তুষ্ট নন তিনি। প্রযুক্তি ব্যবহারে যে ধরনের এক্সপার্টাইজ থাকা দরকার তা তাদের নেই।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি ও অবসটেট্রিকস বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসরিন সুলতানা জুয়েনা বলেন, তাদের বিভাগে অনেক উচ্চ দক্ষতার মেশিনারি রয়েছে। এগুলোর জটিলতা দেখা দিলে মেরামত করার জন্য এক্সপার্ট পাওয়া যায় না। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের বাজেট নেই।