মঙ্গলবার   ১৮ নভেম্বর ২০২৫   অগ্রাহায়ণ ৪ ১৪৩২   ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

রোগীদের জিম্মি করে চিকিৎসকদের ধর্মঘট

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৩৭ এএম, ১৮ জুলাই ২০২৩ মঙ্গলবার

ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর ঘটনায় তিন চিকিৎসককে গ্রেফতারের প্রতিবাদে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসাবে সোমবার রাজধানীসহ সারা দেশে চেম্বারে রোগী দেখা এবং প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া বন্ধ করে দেন চিকিৎসকরা। ঘোষণা দিয়ে প্রাইভেট চেম্বার ও সার্জারি বন্ধের পাশাপাশি গাইনি চিকিৎসকরা রোগী না দেখাসহ প্যাথলজিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট দেখাও বন্ধ রাখেন। এতে দেশের লাখ লাখ রোগী পড়েন চরম বিপদে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে অনেক রোগী জানতে পারেন, চিকিৎসকরা চেম্বার করছেন না। দুদিন ধরে চিকিৎসকদের লাগাতার কর্মসূচিকে অমানবিক বলছেন ভুক্তভোগীরা।

চিকিৎসকদের কর্মবিরতি পালনের দ্বিতীয় দিনে রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, অসুস্থ শিশু, মুমূর্ষু রোগী ও প্রসূতিদের নিয়ে অসহায় সময় পার করছেন স্বজনরা। চেম্বার বন্ধ থাকায় সারা দেশে অসংখ্য গর্ভবতী নারীসহ গাইনিকোলজিক্যাল সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এদিন সকালে ধানমন্ডির সেন্ট্রাল হসপিটাল, তেজগাঁওয়ের শমরিতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মহাখালীর মেট্রোপলিটন হাসপাতাল, গ্রীন রোডের কমফোর্ট, গ্রীন রোডের গ্রীন লাইফ হাসপাতাল, স্কয়ার ও বিআরবি হাসপাতালে প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে। আন্দোলনে থাকা চিকিৎসকরা বলেন, নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই তারা এই কর্মসূচি পালন করছেন।

ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর নবজাতক ও প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনায় দুই নারী চিকিৎসককে গ্রেফতার বেআইনি দাবি করে এই কর্মসূচি পালন করছেন দেশের পেশাজীবী ৩৬টি সংগঠনের চিকিৎসকরা।

দেশের গাইনি চিকিৎসকদের সংগঠন অবস্ট্রেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) শনিবার কর্মবিরতির কর্মসূচি ঘোষণা করে। তাদের পাশাপাশি মেডিসিন, সার্জারিসহ ৩৬টি সংগঠনের প্রায় ৫০ হাজার চিকিৎসক এই কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এরপর থেকেই বেসরকারি হাসপাতালে শুরু হয় অচলাবস্থা।

এদিকে ওজিএসবি চিকিৎসকদের এই কর্মসূচির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও। তারা বলছেন, প্রসূতি সেবা বন্ধ রাখা আর সাধারণ জ্বর উঠলে কিছু টেস্ট লিখে দেওয়া এক নয়। চিকিৎসকের মূল কাজ মানবতার সেবা। মানুষের জীবন রক্ষায় অবদান রাখা। কোনোভাবেই রোগীকে মৃত্যুঝুঁকিতে ঠেলে দেওয়া তাদের কাজ হতে পারে না।

একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, কোনো চিকিৎসক সংগঠন হুট করে এ ধরনের কর্মসূচি দিতে পারে না। রোগীকে জিম্মি করে এ ধরনের কর্মসূচি দেওয়ার আগে সরকারের কাছে দাবি জানানোর সুযোগ র্ছিল। সেই দাবির অংশ হিসাবে তারা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য উচ্চ পর্যায়ে স্মারকলিপি দিতে পারত। কিন্তু এর কোনোটিই না করে সরাসরি চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেওয়া দেশের রোগীদের সঙ্গে বেইমানির শামিল। ওজিএসবির ঘোষিত কর্মসূচির আগে সেন্ট্রাল হাসপাতালের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত দরকার ছিল বলে মন্তব্য করেন তারা।

জানা গেছে, সাধারণ মানের একটি ক্লিনিকেও প্রতিদিন গড়ে ছোট-বড় অন্তত ১০টি অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে। অন্যদিকে বেসরকারি পর্যায়ের বড় হাসপাতালে ৩০ থেকে ৫০টি অপারেশন (ওটি) হয়ে থাকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৪ হাজার ৭০০টি। এর প্রতিটি হাসপাতালে গড়ে ১৫টি করে অস্ত্রোপচার হলেও দিনে প্রায় অর্ধলক্ষের বেশি অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে। একইভাবে নিবন্ধিত প্রায় ১৫ হাজার হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বারেও কয়েক লাখ রোগী চিকিৎসাসেবা ও পরামর্শ নিয়ে থাকেন। পেশাজীবী চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে দেশের লাখ লাখ রোগীর জরুরি সেবা ঝুঁকিতে পড়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওজিএসবি সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক ডা. সালমা রউফ বলেন, প্রাইভেট ক্লিনিকের আউটডোর চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে। ইমার্জেন্সি ক্ষেত্রে যে যার মতো করে সিদ্ধান্ত নেবেন।

চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বার ও সার্জারি বন্ধের কর্মসূচিতে রোগীদের ভোগান্তি প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘চিকিৎসকের মানবিক হওয়া খুব জরুরি। বড় চিকিৎসক হওয়ার চেয়ে মানবিক চিকিৎসক হওয়া খুব জরুরি। তাদের বোঝা উচিত, যে কাজটি করছেন সেটি সঠিক হচ্ছে কিনা। রোগী জিম্মি করা কোনো মানবিক কাজ নয়। চিকিৎসকদের মানবিক হতে হবে, রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হবে কেন? আমি মনে করি, তাদের এখান থেকে ফিরে আসা জরুরি।’

সোমবার রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এ কথা বলেন তিনি।

সেন্ট্রাল হাসপাতালের ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে স্বাস্থ্য সচিব বলেন, ‘সেখানে কী কী বিষয় আছে, সেটা আমরা পর্যালোচনা করে দেখছি। খুব শিগগিরই আমরা ব্যবস্থা নিতে পারব, এ কথা আমরা চিকিৎসকদেরও বলেছি। তারা কর্মসূচি দিলেও আমাদের সরকারি হাসপাতালে সব ধরনের সেবা চালু আছে। আমার বিশ্বাস, এই সমস্যা থাকবে না। এই সমস্যা দু-একদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। আমরা কথা বলেছি, দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে।’

এদিকে এমন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অবিলম্বে আটককৃত নারী চিকিৎসকদের নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে সারা দেশে চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসনের দাবি জানিয়েছে জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদ। সোমবার জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদ আহবায়ক ফয়জুল হাকিম, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা হারুন অর রশিদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রওশন আরা, জনস্বাস্থ্য সংগঠক অনুপ কুন্ডু ও সামিউল আলম এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান। বিবৃতিতে বলা হয়, ১৭ ও ১৮ জুলাই দেশের ক্লিনিক্যাল চিকিৎসকদের ৩৬টি সংগঠনের ডাকে ১৭ হাজার বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সব ধরনের চিকিৎসা, পরামর্শ ও অপারেশন বন্ধ করে দেওয়া অত্যন্ত উদ্বেগের। এর ফলে ডেঙ্গুর বর্তমান বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে আক্রান্ত রোগীদের সুচিকিৎসাও হুমকির মধ্যে পড়বে।

প্রসঙ্গত, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় নবজাতক ও প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনায় দুই চিকিৎসককে গ্রেফতার এবং অপর এক চিকিৎসককে জামিন না দেওয়ার প্রতিবাদে দুই দিন প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখা এবং সার্জারি বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় চিকিৎসকরা। শনিবার ওজিএসবি প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান ও সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক সালমা রউফের সই করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, ১৭ ও ১৮ জুলাই সবার প্রাইভেট চেম্বার ও প্রাইভেট অপারেশন বন্ধ থাকবে। ১৮ জুলাই আবারও বিএমএর সঙ্গে বসে পরবর্তী আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ঢাকার বাইরে চরম দুর্ভোগে রোগীরা
শুধু রাজধানীতেই নয়, দেশের অন্য মহানগর, জেলা ও উপজেলা শহরেও চিকিৎসকরা প্রাইভেট চেম্বার ও অপারেশন বন্ধ রেখে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন। আজও এ কর্মসূচি পালন করার কথা রয়েছে। এমন অবস্থায় রোগীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। রোগীর ভিড় সামলাতে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হয়েছে।

এ সম্পর্কে ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
চট্টগ্রাম: ঢাকায় দুই চিকিৎসককে গ্রেফতারের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে চিকিৎসকরা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসাবে অবস্ট্রেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) চট্টগ্রাম শাখার সদস্যরা সোমবার সব ধরনের অপারেশন বন্ধ রাখেন। একই সঙ্গে তারা প্রাইভেট চেম্বারও করছেন না। এদিকে এ কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে প্রাইভেট চেম্বার ও অপারেশন বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটি ও বাংলাদেশ অটিজম অ্যান্ড ডিজএবিলিটি ইনস্টিটিউট (বাডি)। তবে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ডা. মুজিবুল হক খান বলেন, এ সময়ে জরুরি অপারেশন চলবে।

সিলেট: ঢাকায় গ্রেফতার চিকিৎসক ডা. মুনা সাহা ও ডা. শাহজাদীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে সিলেটে চিকিৎসকরা কর্মসূচি পালন করেছেন। সব ধরনের প্রাইভেট চেম্বার ও প্রাইভেট অপারেশন বন্ধ রয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন রোগীরা।

ওজিএসবির সিলেট শাখার সদস্য ডা. সুরাইয়া আফরোজ জানান, আমাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে অন্য সব বিভাগের চিকিৎসকরাও চেম্বার বন্ধ রেখেছেন। বেসরকারি হাসপাতালেও অপারেশন বন্ধ রয়েছে।

সিলেটের ডাক্তারপাড়াখ্যাত রিকাবীবাজারের স্টেডিয়াম মার্কেটে দেখা যায়, চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ। কর্মসূচির খবর না জানায় রোগীরা এসে পড়েছেন চরম বিপাকে। বেসরকারি হাসপাতালেও একই অবস্থা। রোগী করিম মিয়া জানান, এসে দেখছি চিকিৎসকের চেম্বার বন্ধ। এতে অর্থ ও সময় দুই নষ্ট হলো।

আশুগঞ্জ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া): ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বেতন বৃদ্ধি এবং ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতালের গ্রেফতার দুই চিকিৎসকের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে আশুগঞ্জে সব বেসরকারি হাসপাতালে রোগী দেখা বন্ধ রেখেছেন চিকিৎসকরা।

উপজেলার আড়াইসিধা ইউনিয়নের এক গর্ভবতী সোমবার রেলগেট মেডিল্যাব হাসপাতালে দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করেও চিকিৎসক দেখাতে পারেননি। মেডিল্যাব হাসপাতালের ব্যবস্থাপক বকুল খান বলেন, রোগীরা হাসপাতালে ভিড় করলেও চিকিৎসকরা আসছেন না। চিকিৎসকরা রোগী না দেখলে আমরা কী করব। একই অবস্থা বিরাজ করে উপজেলার সবকটি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে।