মঙ্গলবার   ১৮ নভেম্বর ২০২৫   অগ্রাহায়ণ ৪ ১৪৩২   ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে উজরা-মিশন চুপ হাসিনার অধীনেই কি নির্বাচন?

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৬:২৭ পিএম, ১৪ জুলাই ২০২৩ শুক্রবার

ভারতের মধ্যস্থতায় নমনীয় সরকার : দিল্লি হয়ে ঢাকায় মার্কিন প্রতিনিধি দল : উষ্ণ অভ্যর্থনা

মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে -
আওয়ামী লীগের নেতারা মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ভিসানীতি জারি করার পর খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাব না। আবার বলেছেন, সেন্টমার্টিন দিয়ে দিলে আবার ক্ষমতায় যেতে পারি। প্রধানমন্ত্রী এও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশে সরকার পাল্টে দেয়। আমেরিকা শেখ হাসিনাকে চায় না। এমন সব হার্ডলাইন কথাবার্তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা উজরা জেয়ার নেতৃত্বে মার্কিন প্রতিনিধি দলের সফরকে অতিশয় কড়া সফর বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, শেখ হাসিনার সরকার অনেক বেশি উষ্ণতা দেখাল। জবাবে উজরার কন্ঠে তেমন খেদোক্তি দেখা গেলো না। বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর উল্টো সুর দেখা গেলো।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন মন্ত্রীর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের পর এক টুইটে উজরা জেয়া লেখেন, ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। এছাড়া, পুরো সফরে বিরোধী দলের দাবির তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে কোনও কথা নেই। সংলাপ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন এবং ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। ভারত হয়ে উজরা জেয়ার বাংলাদেশ সফরের পর ঢাকার রাজনীতিতে উত্তাপ দেখা গেলেও এখন হিসাবে গড়মিল। গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া জোরদারের লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান জোরালো করা, মানবাধিকার ইত্যাদি প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জোরালো আহ্বান আছে বটে; কিন্তু ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল কিংবা রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ফোকাসটাই বেশি। সেই ক্ষেত্রে, আরেকবার আরেকটি নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে অনুষ্ঠানের প্রতি প্রচ্ছন্ন সায় কি লক্ষণীয়-এমন প্রশ্ন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে।
উজরা জেয়ার সফরের ব্যাপারে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে একটা আলোচনা ছিল যে, ব্যাপারটা খুবই গায়ে পড়ে কূটনীতির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ভেতরে ভেতরে একটা কৌতুহল দানা বেঁধে ছিল। কী হতে যাচ্ছে! সরকারের তরফে শুরুতেই এটাকে রুটিন সফর বলে চালানো হয়েছে। কিন্তু সরকারের উপর মহল থেকে সফরে সম্পর্ক ঝালাই করার পরিচর্যা যেমন ছিল; তেমনি বাইডেন প্রশাসনের এই দলেরও ছিল সাবধানে পথ চলা। যুক্তরাষ্ট্রের আলোচিত কূটনীতিক ডোনাল্ড লু প্রতিনিধি দলে অর্ন্তভুক্ত ছিলেন। পাকিস্তানে ইমরান খান সরকার পতনের সময় তাঁর নাম উচ্চারিত হয়েছে। ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা ইমরান নিজেই অভিযোগ করেন যে, লু তাঁর সরকারের পতনের নেপথ্যে কাজ করেছেন। বাইডেন প্রশাসনের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু কাছাকাছি সময়ে দুই দফা ঢাকা সফর, বাংলাদেশের ওপর ভিসানীতির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ এবং অপরাপর মার্কিন টুলস নিয়ে নাড়াচাড়া দেখে এক দিকে সরকারি মহলে খানিকটা বিচলিত ভাব ছিল।
অপরদিকে, সাম্প্রতিকালে প্রথমবারের মতো দিল্লি হয়ে কোনও মার্কিন প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফর ওয়াশিংটনের নীতিতে কিছুটা হলেও নমনীয় বার্তারই প্রতিফলন বলে মনে করছেন বিশ্লেষক মহল। ভারত, রাশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশ শেখ হাসিনার সরকারের প্রকারান্তরে পক্ষেই আছে। সূত্রমতে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ওয়াশিংটন সফরের আগে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল বাংলাদেশের কাছে চিঠি দিয়ে সেই তথ্যের ভিত্তিতে তাঁর মার্কিন কাউন্টারপার্টের (প্রতিপক্ষ) প্রতিবেশি দেশের ইস্যুতে বৈঠকের এজেন্ডা নির্ধারণ করেছিলেন। স্পষ্টত দোভাল বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষে দিল্লির অবস্থানের কথা জ্যাক সুলেভানকে জানিয়েছেন। তারপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। ঢাকায় সবার চোখ ছিল হোয়াইট হাউসের দিকে। দিল্লির শেখ হাসিনার পক্ষে থাকার কথাটা মোদী আরেক দফায় বাইডেনের মাধ্যমে ওয়াশিংটনকে অবহিত করেন কিনা সেটিই দৃষ্টিতে ছিল। মোদীর ডিমেনশিয়ায় নাকি সময়ের স্বল্পতায় তা ঢাকা পড়েছিল দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক পরিস্থিতি আলোচনার মধ্যে তা একদমই বোঝা যায়নি। তবে বিজেপি সরকারের বাংলাদেশ সংক্রান্ত কূটনৈতিক নীতির কর্ণধার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা যিনি বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন; তিনি স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন, বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক যে উচ্চতায় পৌঁছেছে তা গত ৪০ বছরেও হয়নি। শ্রিংলা যুক্তরাষ্ট্রেও ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তিনি। বর্তমানে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের মূল ব্যাক্তি। তাঁর এমন মন্তব্যের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্ডার সেক্রেটারির বাংলাদেশ সফরের আগে দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রার সঙ্গে বৈঠকে কী আলোচনা হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এই অঞ্চলে স্পষ্টত যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাচারেল অ্যালাই’ ভারত ওয়াশিংটনকে কোন পর্যায় থেকে বার্তা দিয়েছে সেটা মুখ্য নয়; বরং কী বার্তা দিয়েছে সেটাই বিবেচ্য।
উজরা জেয়ার বাংলাদেশে পদার্পণের পূর্বেই ওয়াশিংটন থেকে উড়ে এসেছেন রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান। এই পর্যায়ের মার্কিন কূটনীতিকের জন্যে স্বাভাবিক সময়ে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতের আগাম দেশে আসার কথা নয়। ইমরানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি দিল্লিতেও বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন। র‌্যাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে স্যাংশন দেয়ায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ‘জরুরী অবস্থা’ চলাকালে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হয়। তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে শুরু করে কংগ্রেস পর্যন্ত প্রতিদিন বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কড়া বিবৃতি, বাইডেনের কাছে ছয় কংগ্রেসম্যানের চিঠি কিংবা ঢাকায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক মহলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উচ্চবাক্যের মধ্যেও ইমরান মাথা ঠান্ডা রেখেছেন। ভিসানীতির পরও তাঁর ইতিবাচক দিক খোঁজে বের করে তিনি দেখালেন, ভিসানীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে কোনও মন্তব্য নেই। তাঁর স্পষ্ট কথা, এতটা উতলা না হয়ে দেখি না কী করা যায় !
মোহাম্মদ ইমরান ঢাকায় এসে বাংলাদেশকে প্রস্তুত করলেন উজরাকে স্বাগত জানানোর জন্য। বিমান বন্দরে ছুটে গেলেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। এই পর্যায়ের কর্মকর্তাকে সংশ্লিষ্ট মহাপরিচালক স্বাগত জানানোই যথেষ্ঠ ছিল। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে বিমানবন্দরে পররাষ্ট্র সচিবের স্বাগত জানানোই শুধু নয়; বরং গণভবণে সাদর সম্ভাষণ জানালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে। কয়দিন আগেই যার কন্ঠে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা; সেই তিনিই প্রধানমন্ত্রী হয়েও দিল্লিতে সর্বোচ্চ পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠককারী বাইডেন প্রশাসনের এক কর্মকর্তাকে এতটা সমাদর করলেন। ফলাফলও মিলল। উজরা জেয়া টুইট করে লেখেন, ফলপ্রসূ আলোচনাই হয়েছে। উভয় পক্ষের এই নমনীয়তা কিসের ইঙ্গিত তা আরও কিছুদিন গেলে স্পষ্ট হবে। তবে ঢাকায় মোহাম্মদ ইমরানরা সম্ভবত মনে করেন যে, শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগারকারী মহলের প্ররোচনায় বাইডেন প্রশাসনের নীতিতে কিছুটা হলেও নমনীয় ভাব দেখা যাবে উজরা মিশনের সফরে অনেক বিষয় প্রত্যেক্ষ করার পর।
অবশ্য সতর্কবার্তাও আছে, ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের বিবৃতিতে যেখানে প্রতিফলিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মতো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করে গণতন্ত্রকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্যে টেকসই করার আহ্বান। সুশীল সমাজের সমালোচনাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার উপাদান হিসাবে গ্রহণ এবং স্বাধীন গণমাধ্যম, মানবাধিকার, সভা-সমাবেশ ও শ্রম অধিকারের মতো মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক মূল্যবোধের প্রতি অবিচল থাকার ইঙ্গিতই দিচ্ছে।