হাটে ক্ষমতার দাপট, ইচ্ছামতো হাসিল
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৪:২৮ এএম, ২৭ জুন ২০২৩ মঙ্গলবার
চট্টগ্রাম নগরীর নূরনগর হাউজিং এস্টেট মাঠের পশুর হাট থেকে গত রোববার ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় গরু কেনেন ব্যবসায়ী আশফাকুল আলম। গরু কিনে হাসিল দিতে গিয়েই বাধে বিপত্তি। ইজারাদারের কর্মী গরুটির হাসিল দাবি করেন সাড়ে ৭ হাজার টাকা। এ নিয়ে বিতণ্ডার একপর্যায়ে সাড়ে ৬ হাজার টাকা গছিয়ে হাট থেকে গরু বের করেন তিনি। এমনিতেই গরুর বাজারে আগুন। এই পরিস্থিতিতেও বাড়তি হাসিলের মাধ্যমে ক্রেতার পকেট কাটছেন ইজারাদাররা। সরকার নির্ধারিত হাসিলের পরিমাণ গরুর মূল্যের ৫ শতাংশ হলেও অনেক হাটে আদায় করা হচ্ছে ৭ শতাংশ পর্যন্ত।
এদিকে কোরবানির পশুর হাটে হাসিলের তালিকা টানানো বাধ্যতামূলক। তবে অনেক হাটে তা টানানোর প্রয়োজন মনে করছেন না প্রভাবশালী ইজারাদাররা। অভিযোগ রয়েছে, দেশের বিভিন্ন এলাকার অধিকাংশ হাটের ইজারা পেয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। ফলে স্থানীয় প্রশাসন এই অনিয়ম দেখেও চোখ বুজে আছে। এ সুযোগে ইচ্ছামতো হাসিল তুলছেন ইজারাদাররা। এতে কোরবানির পশু কিনতে গিয়ে মানুষ হয়রানির মুখে পড়ছেন। এমনকি, বিক্রেতাদের কাছ থেকেও নেওয়া হচ্ছে হাসিল, অথচ বিক্রেতাদের হাসিল দেওয়ার নিয়ম নেই। অতিরিক্ত হাসিল নেওয়ার পটভূমিতে স্থানীয় প্রশাসন কোরবানির পশুর হাটে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানোর কথা ভাবছে।
বগুড়ার অন্যতম হাট মহাস্থান। মহাস্থান হাটে গরু কিনতে আসা ক্রেতারা জানান, এই হাটে রীতিমতো হাসিল সন্ত্রাস করা হচ্ছে। সেখানে গরুপ্রতি নির্ধারিত ৫০০ টাকার বদলে ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। ছাগলের জন্য নির্ধারিত ১৫০ টাকার স্থলে আদায় হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এ ছাড়া বিক্রেতারা এবারই প্রথম হাসিলের আওতায় এসেছেন। তাদের গড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা করে দিতে হচ্ছে।
মহাস্থানহাটের ইজারাদার বগুড়া সদর আসনের এমপি রাগেবুল আহসান রিপুর শ্যালক শফিকুল ইসলাম। বগুড়ার বড় বড় হাটের মধ্যে রনবাঘা হাট নিয়ন্ত্রণ করছেন সদর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান রাজ, ডাকুমারা হাটে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জুলফিকার রহমান শান্ত, জামুরহাটে যুবলীগ নেতা মতিন সরকার, চাঁদমুহু হাটে সদর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শফিক, নামুজা হাটে আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব আলম, ধাপেরহাটে যুবলীগ নেতা মতিন সরকারের সহযোগী ময়না, কালীতলা হাটে পৌর মেয়র রেজাউল করিম বাদশার ছোট ভাই মাহবুব খোকন, বনানী হাটে বগুড়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কবির আহম্মেদ মিঠু, কিচকহাটে শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শাজাহান চৌধুরী এবং গাড়িদহ হাট নিয়ন্ত্রণ করছেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি টুটুল হোসেন।
মহাস্থান হাটের ইজারাদার শফিকুল ইসলাম বলেন, হাট সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বেশ কিছু লোক রাখতে হয়েছে। এ ছাড়া হাটের বার্ষিক ডাকে টাকার অঙ্কও বেড়েছে।
একাধিক ক্রেতা জানান, প্রতিটি হাটে হাসিল তোলার জন্য কর্মীবাহিনী নিয়োগ দিয়েছেন ইজারাদার। তাঁরা জোর করে দুই থেকে তিন গুণ নিচ্ছেন।
বগুড়া শহরের সাবগ্রাম ও কালীতলা হাটের ক্রেতারা জানান, সেখানে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা পর্যন্ত হাসিল নেওয়া হচ্ছে। হাসিলের টাকা নিয়ে ইজারাদারের পক্ষে যে স্লিপ দেওয়া হচ্ছে তাতে শুধু গরুর দর লেখা। হাসিলের অঙ্ক লেখা নেই। কোনো ক্রেতা এই রসিদ নিতে না চাইলে হুমকি-ধমকি দিয়ে তাকে হাট থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
বগুড়ার জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, জেলায় অতিরিক্ত হাসিলের কোনো অভিযোগ কেউ করেনি। এ ব্যাপারে সজাগ রয়েছি। প্রয়োজনের যে কোনো হাটে অতিরিক্ত হাসিল বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।
জয়পুরহাটের পাঁচবিবি হাটের ইজারাদার আব্দুল হাকিমের নাম থাকলেও এটা নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হাবিবুল ইসলাম। এখানে সরকার নির্ধারিত হাসিলের অনেক বেশি টাকা তোলা হচ্ছে। সদরের অন্য হাটটি নিয়ন্ত্রণ করছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক মোস্তাফিজার রহমান। তিনি তাঁর সহযোগী দিয়ে হাট চালিয়ে বেশি টাকা আদায় করছেন। একই অবস্থা গাইবান্ধার দারিয়াপুর ও মহিমাগঞ্জ হাটের। এই হাটে অতিরিক্ত হাসিলের অভিযোগে ইজাদারের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন।
রংপুর নগরীর পশুর হাটগুলোর মধ্যে অন্যতম বুড়িরহাট। সেখানে ঈদের আগে শেষ হাট ছিল গতকাল সোমবার। হাটে আসা পাইকার ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্রেতাদের কাছে অতিরিক্ত হাসিলের পাশাপাশি বিক্রেতাদের কাছেও নেওয়া হচ্ছে। অথচ বিক্রেতাদের কাছে হাসিল নেওয়ার নিয়ম নেই।
হাটে গরু কিনতে নওগাঁ থেকে আসা পাইকার মোহাম্মদ আলী বলেন, একটি গরু কিনতে ইজারাদারকে ১ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। আমি যাঁর কাছ থেকে গরু কিনেছি, তাঁকেও দিতে হয়েছে ৫০০ টাকা। অর্থাৎ ক্রেতা-বিক্রেতা মিলে একটি গরুর জন্য হাসিল দিতে হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ টাকা।
রংপুরের হাটবাজারের প্রতিটি গরু ৪০০ টাকা ও ছাগল ১৫০ টাকা হাসিল নির্ধারণ করা হয়েছে। নিয়ম অনুসারে এই হাসিল কেবল ক্রেতার দেওয়ার কথা। অথচ এই নিয়মের কোনো তোয়াক্কাই করছেন না ইজারাদাররা।
অতিরিক্ত টাকা আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে বুড়িরহাটের ইজারাদার হারুন অর রশিদ বলেন, সরকার প্রায় ১৬ বছর আগে এ হাসিল নির্ধারণ করে। আমরা হাসিলের দর পরিবর্তনের জন্য প্রশাসনের কাছে দাবি জানালেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। তবে আমরা পাইকারদের কাছে হাসিল নিচ্ছি, কৃষকদের কাছে নয়। শুধু বুড়িরহাটে নয়; রংপুরের বড় পশুর হাট তারাগঞ্জ, বড়াইবাড়ীহাট, লালবাগ, চৌধুরানীর হাট, নজিরেরহাট, পাওটানাহাট, কান্দিরহাট, সৈয়দপুরহাট, দেউতি, মিঠাপুকুর, বৈরাতি, জায়গিরহাট, শঠিবাড়ী, বালুয়াহাট, মাদারগঞ্জহাট ও ভেন্ডাবাড়ীহাটেও কোরবানির পশু কেনাবেচার শেষ সময় একই চিত্র দেখা গেছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীন বলেন, পশুর হাটে হাসিলের জন্য ইজারাদারদের নির্ধারিত তালিকা টাঙিয়ে সে মোতাবেক নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যদি ব্যত্যয় ঘটে, তবে এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রংপুরের পীরগাছায় পাওটানা ও চৌধুরানী হাটে প্রতিটি গরু ক্রেতা ৭০০ ও বিক্রেতা ৩০০ মিলিয়ে ১ হাজার টাকা এবং প্রতিটি ছাগল ক্রেতা ৩০০ টাকা ও বিক্রেতা ২০০ টাকা মিলিয়ে ৫০০ টাকা হাসিল রাখা হচ্ছে। পাওটানা হাট ইজারাদার আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হাকিম জানান, বেশি দামে হাট নেওয়া হয়েছে, তাই বেশি টাকা তোলা হচ্ছে।
সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা সদরের পশুর হাটে যে কোনো দামে পশু কিনলেই ১ হাজার টাকার হাসিল দিতে হচ্ছে ক্রেতাদের। একইভাবে বিয়ানীবাজারের বারইগ্রাম হাটে দেড় হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া স্থায়ী হাটের চেয়ে অস্থায়ী হাটের ইজারাদারদের বিরুদ্ধে বেশি হাসিল নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
বরিশালে অতিরিক্ত হাসিলের অভিযোগ পাওয়া না গেলেও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধের মুখে পড়েছে পশুর হাট। ৫ দিন পশু ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য নগরীতে দুটি অস্থায়ীসহ মোট ৩টি হাটের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের বিরোধে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে রূপাতলী শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সেতুর (দপদপিয়া সেতু) ঢালের নিচে অস্থায়ী হাট চালু করা যায়নি। স্থায়ী হাট ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাঘিয়ায় ও ২ নম্বর ওয়ার্ডে কাউনিয়া টেক্সটাইল মিল-সংলগ্ন বালুর মাঠে অস্থায়ী হাটে নির্ধারিত সময় গত শনিবার থেকে পশু বেচাকেনা শুরু হয়েছে।
এদিকে গতকাল গাবতলী কোরবানির পশুর হাটে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, প্রতি বছরের মতো এবারও কোরবানির হাটকেন্দ্রিক র্যাবের পক্ষ থেকে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে অতিরিক্ত হাসিল নেওয়ার অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।- সমকাল
