শুক্রবার   ১৭ মে ২০২৪   জ্যৈষ্ঠ ২ ১৪৩১   ০৯ জ্বিলকদ ১৪৪৫

মনোমুগ্ধকর আবৃত্তি অনুষ্ঠান

জয়িতার গল্পে নিজের কথাই বললেন শুক্লা

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:৫৫ এএম, ১৭ জুন ২০২৩ শনিবার



   
আজকাল প্রতিবেদন -
‘এই যে আমি, আমার সব সময় মনে হয় প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব একটা আলো থাকে। সবাই কি সেই আলোর খোঁজ পায়? অন্ধকারে হাজার প্রদীপ জ্বালিয়েও কখনও  হয়ত সে আলোর দেখা মেলে না। সে আলোর শক্তি অনুভবে, বিশ্বাসে’।
কানায় কানায় পূর্ণ মিলনায়তনের শ্রোতারা, মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন একজন জয়িতার গল্প। জয়িতার জীবনের গল্প। না শুধু জয়িতা নয়, জয়িতার জীবনের সাথে জুড়ে থাকা আর একটি নাম, শোভনের গল্প। জয়িতা আর শোভনের গল্পই আমাদের শোনাচ্ছিলেন শুক্লা রায়। জয়িতা মানিকগঞ্জের কালীগঙ্গা তীরের গ্রাম থেকে উঠে আসা এক মেয়ে। জয়িতা বুড়িগঙ্গার তীর ছুঁয়ে হাডসনের তীরে থিতু হওয়া এক মেয়ে। এ জয়িতা জানে তার আর কালীগঙ্গার তীরে ফেরার পথ নেই। তবুও জয়িতার চোখে এখনও ভাসে তার গ্রামের দিগন্ত বিস্তৃত অনন্ত নীল আকাশ। জয়িতার সেই আকাশ আজ সীমিত হয়ে গেছে ম্যানহাটানের আকাশচুম্বি ভবনচূড়ার ছোট্ট পরিসরে।
জয়িতা সাধারণ এক মেয়ে। এই সাধারণ একটি মেয়ের গল্প আমরা পিনপতন নীরবতায় স্তব্ধ হয়ে শুনছিলাম শুক্লা রায়ের মুখে। এমন সাধারণ মেয়ে তো আমাদের সমাজে সর্বত্রই বিরাজ করছে। শুক্লা রায়ের ভাষায়, সব সাধারণ মেয়ের জীবনেই চড়াই-উৎরাই আছে, প্রেম আছে। প্রেমের পরিণতিতে সাফল্য যেমন আছে, ব্যর্থতাও আছে। এই আটপৌরে জীবনের চৌহদ্দির বাইরে জয়িতা নামের মেয়েটার এমন আর কোন বিশেষত্ব নেই যা তাকে ভিন্ন কোন বৈশিষ্ট্য দিতে পারে। তার প্রেমও এই সাধারণ চৌহদ্দির সীমা অতিক্রম করতে পারেনি, কখনই মুখ ফুটে শোভনকে বলতে পারেনি ভালবাসার কথা। তার অনুযোগ, সব কথাই কি মুখ ফুটে বলতে হবে? শরীরের কি কোন ভাষা নেই? জয়িতাকে নিয়ে শুক্লা রায়ের এ গল্প পুরো দেড় ঘন্টার। যে গল্প শুধু বিষাদই ছড়িয়েছে, যে গল্পে রয়েছে শুধু দীর্ঘশ্বাস। যে গল্পে জয়িতার বড় বোনের মৃত্যুর কথা আছে, যে গল্পে আছে জয়িতার মায়ের দুঃখ-কষ্টের কাহিনী। যে কাহিনী বলতে গিয়ে শুক্লা নিজের অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি, শ্রোতাদের চোখও ভিজিয়ে দিয়েছেন। কাহিনীর মাঝেই চোখের পানি মুছে নিয়ে শুক্লা দর্শক আসনে সামনের সারিতে বসা তাঁর মাকে হাত জোড় করে প্রণাম জানিয়ে পরিবেশটা আরো ভারি করে তোলেন।   
জয়িতার গল্প তিনি শেষ করেছেন রফিক আজাদের কবিতা ‘যদি ভালবাসা পাই আবার শুধরে নেব  জীবনের ভুলগুলি’, নজরুলের ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেব না ভুলিতে’ আর সবশেষে রবীন্দ্র সঙ্গীত ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ দিয়ে। জয়িতার গল্প শেষ করেই শুক্লা বললেন, ‘আমার জীবনের গল্পটা কিন্তু এর থেকে আলাদা কিছু নয়’। বললেন, ‘সবাই জয়ী হতে আসে, সবার গলায় কিন্তু সেই পদক জোটে না। আমি জয়ী হতে আসিনি, আমি কেবল নিজের আলো ছড়াতে এসেছি’।   
পুরো দেড় ঘন্টার অনুষ্ঠানে দর্শকরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্থাণু হয়ে ছিলেন। এ অনুষ্ঠান ছিল নিউইয়র্কের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ আবৃত্তিশিল্পী শুক্লা রায়ের একক আবৃত্তির। তাঁর আলো ছড়ানো এ অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘আমার আপন আলোয়’। একক আবৃত্তির অনুষ্ঠান অনেকই হচ্ছে, কিন্তু  শুক্লার এই অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা ছিল একেবারেই ভিন্নধর্মী। অনুষ্ঠানে ছিল নতুনত্ব, পরিবেশনা ছিল ব্যতিক্রমী। অনুষ্ঠানটি ছিল এক কথায় অসাধারণ। নিপুণ এবং সুচারু একটি আয়োজন।
শুক্লা রায় আবৃত্তি করেছেন জসীমুদ্দিন, যতীন্দ্রমোহন বাগচী থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, আবিদ আজাদ-সহ মোট একুশজন কবির কবিতা। কিন্তু সব কবিতার উপস্থাপনাই ছিল তাঁর গল্পের অংশ হিসেবে। পরিবেশনার শুরুতেই শুক্লা বলেছিলেন, তিনি একটি গল্প শোনাতে চান। জয়িতা আর শোভনের গল্প। সেই গল্প শুনিয়ে তিনি আবেগাপ্লুত করেছেন শ্রোতাদের। গল্পের অনুষঙ্গ হিসেবে তিনি সংযোজন করেছেন কবিতা আর গান। সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন সেতার, বাঁশি আর কী বোর্ডের আবহ। সব মিলিয়ে প্রশংসনীয় একটি আয়োজন। নিটোল তাঁর গল্পের বর্ণনা, যেমন ভাষায় তেমনি গ্রন্থনায়।
গত রোববার জ্যাকসন হাইটসের জুইশ সেন্টারে সাহিত্য একাডেমী এবং আবৃত্তি ডটকমের সহযোগিতায় নান্দনিক আয়োজিত শুক্লা রায়ের এই অনুষ্ঠানে লক্ষ্য করার মতো বিষয় ছিল শ্রোতা সমাগম। নিউইয়র্কে কবিতাপ্রেমী বাংলাদেশিদের এমন ব্যাপক বিস্তৃতি নিঃসন্দেহে আনন্দদায়ক।  শুক্লার গল্প আর কবিতার সঙ্গে ছিল ওস্তাদ মোরশেদ খানের সেতারের মূর্চ্ছনা, মোহাম্মদ মজিদের বাঁশির উদাসী সুর, রিচার্ড রিকি গোমেসের সঞ্চালনায় কিবোর্ডের সঙ্গত। আবৃত্তি অনুষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করেছেন ক্রিস্টিনা লিপি রোজারিও তাঁর সঙ্গীত দিয়ে। রবীন্দ্র, নজরুল, ডিএল রায়,  আধুনিক, বাউল ঘরাণার সব গানই পরিবেশনায় ছিলেন তিনি। তাঁর সাথে শেষ রবীন্দ্র সঙ্গীতটিতে গলা মিলিয়েছেন রিচার্ড রিকি গোমেস। রিকি এককভাবেও পরিবেশন করেছেন ভূপেন হাজারিকার ‘গঙ্গা তুমি বইছ কেন’ গানটি। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা ছিল উল্লেখ করার মতো। এ কৃতিত্ব তাহরিনা পারভীন প্রীতির। আর শুক্লা রায়ের পরিচিতি শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরেন আবৃত্তিকার পারভীন সুলতানা। তিন ভাগে ভাগ করা মঞ্চের ব্যবস্থাপনাকে আপাতভাবে আড়ম্বরহীন মনে হলেও মঞ্চসজ্জা ছিল আকর্ষণীয়। মঞ্চে ছিল কিছু কবিতার বই, সাবেকী আমলের প্রতীকী একটি বড় লন্ঠন, ছিল পত্রগুল্ম শোভিত পুষ্পাধার, ছিল ছোট টবে ফুটন্ত ফুল। সব কিছুই শৈল্পিক, দৃষ্টিনন্দন।
দীর্ঘ সময় ধরে গল্প শুনিয়ে গেছেন শুক্লা রায়। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে এ তাঁর আবৃত্তির অনুষ্ঠান নয়, তাঁর গল্প বলাটাই এখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু বলতেই হবে একুশটি কবিতা নিয়ে সাজানো তাঁর আবৃত্তি অনুষ্ঠানের এই আঙ্গিক শ্রোতারা গ্রহণ করেছেন, অনুষ্ঠান শেষে তারা বিপুলভাবে অভিনন্দিত করেছেন তাঁকে। শুক্লার পরিবেশনায় কোথাও কোন ছন্দ পতন ছিল না,  ছিল না তাল-লয়ের অসঙ্গতি। সাবলীলভাবে সাধারণ ভাষায়, এবং বলতে দ্বিধা নেই, যথেষ্ট সাহসের সঙ্গে বলে যাওয়া তাঁর এই আত্মজৈবনিক গল্প সবার হৃদয় স্পর্শ করেছে। তাঁর কন্ঠের কারুকার্যে, তাঁর প্রকাশভঙ্গীতে, তাঁর অভিব্যক্তিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে গল্প-বলা। তাঁর এই অনবদ্য পরিবেশনা  দর্শকদের মনে ধরা রইবে বহুদিন।