বুধবার   ১৯ নভেম্বর ২০২৫   অগ্রাহায়ণ ৪ ১৪৩২   ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

সেন্টমার্টিন চায় যুক্তরাষ্ট্র

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:২০ এএম, ১৭ জুন ২০২৩ শনিবার

বাংলাদেশের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক
ও নিরাপত্তা অঙ্গনে নানা আলোচনা


 
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে -
বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে সামরিক ঘাঁটি করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে নজরদারির স্বার্থে বিশ্বের সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষমতাধর দেশটির এমন ইচ্ছা দীর্ঘদিনের। তবে সাম্প্রতিককালে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেড়েছে। যদিও ওয়াশিংটনের তরফে বিষয়টি নিয়ে এখনও পর্যন্ত প্রকাশ্যে কিছু বলা হয়নি। তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা অঙ্গনে বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে বাংলাদেশের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টির প্রেক্ষিতে বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। সেন্টমার্টিনের স্থানীয় মানুষ জন বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র দ্বীপটিতে আপাতত একটি মেরিন একাডেমী স্থাপন করতে চায় বলে তারা শুনেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে বাংলাদেশের জন্যে যে ভিসানীতি করেছে সেটিও সেন্টমার্টিনকে পাওয়ার কৌশল বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে চাউর আছে। বঙ্গোপসাগরের ওপর কৌশলগত নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মেরিন একাডেমীর নামে কার্যত মার্কিন সৈন্যদের ঘাঁটি করার কৌশল বলে মনে করেন অনেকে। এই কৌশল বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র এতদিন ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করলেও এখন খুব জোরেসোরে অগ্রসর হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর অংশ হিসাবে ভিসানীতি ও নিষেধাজ্ঞা (স্যাংশন) দেয়া হচ্ছে বলে কেউ কেউ মনে করেন।
সেন্টমার্টিন দ্বীপটি যুক্তরাষ্ট্র কেন চায় জানতে চাইলে ঢাকাভিত্তিক ‘সিকিউরিটি’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক রব মজুমদার আজকালকে বলেন, ‘এটা একটা জটিল প্রশ্ন। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন দ্বীপ পাওয়ার জন্যে কোনও আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব এখনও দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করে সেন্টমার্টিন দ্বীপ যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করতে চায় বলে মনে করা হয়। বিষয়টা এখনও অনুমান নির্ভর’। তিনি আরও বলেন, ‘বিশে^র আশিটির মতো দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য আছে। দেশগুলোতে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আছে। বঙ্গোপসাগরেও তাদের একটা ঘাঁটি থাকলে সেটা তাদের জন্যে ভাল’। তবে রব মজুমদার মনে করেন, বঙ্গোপসাগরে মার্কিন ঘাঁটি বাংলাদেশের জন্য ভাল নয়।
সেন্টমার্টিন দ্বীপ যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা সেটা সম্প্রতি প্রকাশ্যে এনেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি। ওয়ার্কার্স পার্টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অংশ। বুধবার জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তৃতায় রাশেদ খান মেনন বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি রেজিম চেঞ্জের কৌশলের অংশ। তারা সেন্টমার্টিন চায়, কোয়াডে বাংলাদেশকে চায়। বর্তমান সরকারকে হটানোর লক্ষ্যে তারা সবকিছু করছে।
বুধবার (১৪ জুন) জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। রাশেদ খান মেনন বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যারা বন্ধু তাদের শত্রুর প্রয়োজন নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তার বাগে রাখতে এরআগে স্যাংশন দিয়েছে। এখন নির্বাচনকে উপলক্ষ্য কওে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। এটা কেবল দুরভিসন্ধিমূলকই নয়, তাদের রেজিম চেঞ্জের কৌশলের অংশ। তারা সেন্টমার্টিন চায়, কোয়াডে বাংলাদেশকে চায়।
রাশেদ খান মেনন বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ছিনিয়ে নিতে তারা বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল। তীব্র খাদ্য সংকটের সময় বঙ্গবন্ধুর সরকারকে বিব্রত করতে মধ্যসমুদ্র থেকে গমের জাহাজ ফিরিয়ে নিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পিছনে তাদের কালো হাত ছিল। এখন আবার বর্তমান সরকারকে হটানোর লক্ষ্যে তারা সব কিছু করছে।  
রাশেদ খান মেননের ‘যুক্তরাষ্ট্র চায় সেন্টমার্টিন’ বলে যে বক্তব্য রেখেছেন, তাকে ‘হুজুগে মন্তব্য’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, থাইল্যান্ড ও ভারতের মতো মিত্র দেশ থাকার পর সেন্টমার্টিনে মার্কিন ঘাঁটি করার প্রয়োজন নেই। ফলে এ ধরনের ইমোশনাল বক্তব্য রাখা উচিত নয়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে দক্ষিণের ভূখন্ড টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটারের মতো দক্ষিণে অবস্থিত সেন্টমার্টিন দ্বীপটি স্থানীয়দের কাছে নারিকেল জিঞ্জিরা বা দারুচিনি দ্বীপ হিসাবে পরিচিত। ২৫০ বছর আগে আরব নাবিকেরা প্রথম এ দ্বীপে বসবাস করেন। তারা এর নাম দেন জাজিরা। ব্রিটিশ শাসনের সময় প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে টেকনাফের মূল ভূমির অংশ ছিল দ্বীপটি। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি সমুদ্রের নিচে চলে যায়। এরপর প্রায় ৪৫০ বছর আগে বর্তমান সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ অংশটি জেগে ওঠে। এর একশ বছরের মধ্যে উত্তর অংশ এবং পরবর্তী একশ বছরের মধ্যে বাকি অংশ জেগে ওঠে।
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯০০ সালে ভূমি জরিপের সময় এ দ্বীপটিকে ব্রিটিশ ভারতের অর্ন্তভূক্ত করা হয়। সে সময়ে বার্মা ব্রিটিশ শাসনের আওতায় ছিল। কিন্তু তারপরও সেন্টমার্টিন দ্বীপকে বার্মার অর্ন্তভূক্ত না করে ব্রিটিশ ভারতের অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছিল। এর আগে ১৮২৪ থেকে ১৮২৬ সালে ব্রিটিশদের সাথে বর্মী রাজার যে যুদ্ধ হয় তাতে বিতর্কের ইস্যুগুলোর মধ্যে এ দ্বীপের মালিকানাও ছিল অন্যতম। সেন্টমার্টিন দ্বীপের আয়তন প্রায় আট বর্গ কিলোমিটার। এর সঙ্গে সংলগ্ন ছেঁড়া দ্বীপটি মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল থেকে আট কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। ভাটার সময় দুটি দ্বীপ এক হলেও জোয়ারের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
কিছুদিন আগে মিয়ানমার তার দেশের মানচিত্রে সেন্টমার্টিনকে অর্ন্তভূক্ত করে। এ নিয়ে ঢাকায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া পূরণ করতে গেলে সাংঘর্ষিক পরিবেশের সৃষ্টি হবে যা বাংলাদেশ চায় না।