সোমবার   ০৬ মে ২০২৪   বৈশাখ ২২ ১৪৩১   ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আগাম নিষেধাজ্ঞা

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:৩৩ এএম, ২৭ মে ২০২৩ শনিবার

সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বন্ধ

বিশেষ প্রতিনিধি -
বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত বুধবার এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আগাম নিষেধাজ্ঞা জারির এ হুশিয়ারি দেন। ব্লিঙ্কেনের ঘোষণায় নতুন নীতি অনুযায়ী, ভোটে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কোনো বাংলাদেশিকে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে এর জন্য দায়ী ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকা বন্ধ হয়ে যাবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতিতে যাদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করা হতে পারে তাদের মধ্যে বাংলাদেশে কর্মরত কিংবা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, সরকারি বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বিচার বিভাগের কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও রয়েছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ঘোষিত যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নীতি অমান্য করলে যেমন সরকারপক্ষ চাপে পড়বে, একইভাবে বিরোধী দলগুলোও চাপের মুখে থাকবে। নির্বাচনে না গিয়ে সহিংসতার পথে গেলে বিরোধীরাও যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে। এদিকে এ ভিসা নীতি ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি নিয়ে সরকার চিন্তিত নয়। অন্যদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি বলেছেন, দেশের গণতন্ত্র ও সুশাসনকে যারা নষ্ট করেছে, এটি তাদের জন্য বড় নিষেধাজ্ঞা। যে জিনিসটা এসেছে সেটি তাদের শেষ পরিণতির পূর্ব মুহূর্ত বা লক্ষণ।
অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বিবৃতিতে বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে আমি একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করছি। এই নীতির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপে সক্ষম হবে।
এর মধ্যে বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা বা কর্মচারী, সরকার সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের ধারা ২১২ (এ)(৩)(সি)-এর অধীনে নতুন এই ভিসা নীতি ঘোষণা করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এই সিদ্ধান্তের কথা যুক্তরাষ্ট্র সরকার গত ৩ মে বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করেন তিনি।
গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার মধ্যে কোন কোন বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে, তা তুলে ধরে অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজের মধ্যে রয়েছে ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, সহিংসতার মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দেওয়া এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখা।
অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ভোটার, রাজনৈতিক দল, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমসহ সবার। যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায় তাদের সবাইকে আমাদের সমর্থন দিতে আমি এই নীতি ঘোষণা করছি।
এ ছাড়া এক টুইটে ব্লিঙ্কেন বলেন, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করছি। এই নীতি অনুসারে যদি কোনো ব্যক্তি বা তার নিকটাত্মীয়রা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে, তবে জড়িতদের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র।
ভিসা বিধি-নিষেধের বিষয়ে গত বুধবার রাতে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, আজ বাংলাদেশের জনগণের জন্য আমাদের বার্তা হচ্ছে যে, আমরা আপনাদের পেছনে আছি। আমরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পেছনে আছি এবং আপনাদের দেশে গণতন্ত্রকে সহায়তার জন্য আমরা এই নীতি ঘোষণা করছি।
এটা নতুন নিষেধাজ্ঞা নয়-জানিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, এই বার্তা পাঠানো গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা আইনের এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে আমাদের কর্তৃত্ব ব্যবহারে প্রস্তুত আছি।
এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশে যদি কেউ জনগণের ক্ষমতার ওপর হস্তক্ষেপ করতে চায়, তাদের এই বার্তায় দেওয়া যে ওয়াশিংটন ঘটনার ওপর চোখ রাখছে, যাতে জনগণ ভরসা পায়। আমরা মনে করি, আইনের এই ধারা প্রয়োগের সামর্থ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের কাছে এমন সংকেত পাঠানোও গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে আছি, আর আমরা অ্যাকশন নিতে প্রস্তুত।
এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার বা প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক বা সমালোচনা করা হলো কি না জানতে চাইলে মুখপাত্র বলেন, না। নতুন নীতি ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই বার্তা দেয়া হলো, আমরা বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে সমর্থন করি। এই প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করলে আমরা কোনো ব্যক্তিকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে পারি। এটা সামরিক বাহিনী, বিচার বিভাগসহ সবার জন্যই প্রযোজ্য একটি বার্তা।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি নিয়ে সরকার চিন্তিত নয় বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। গত বুধবার রাতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, এটি স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা নয়। এ নিয়ে বিএনপির উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। নির্বাচনের আগে বা পরে যে কোনো প্রকার সহিংসতা ঘটালে সেটি তাদের ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
যুক্তরাষ্ট্র সফররত আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন আজকালকে বলেন, এটি কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলে আসছেন। বিএনপিই নির্বাচন বানচাল করতে চায়। তাই যুক্তরাষ্ট্রের এ ঘোষণা বিএনপির কার্যকলাপের প্রভাব। এতে আওয়ামী লীগের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
এদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি বলেন, দেশের গণতন্ত্র ও সুশাসনকে যারা নষ্ট করেছে, এটি তাদের জন্য বড় নিষেধাজ্ঞা। দেশের বাইরে ও ভেতরে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বহির্বিশ্ব থেকে সরকারকে সতর্ক করেছে। কিন্তু সরকার তো কারও কথা শুনছে না। তারা তাদের দৌরাত্ম্য ও লম্ফঝম্প অব্যাহত রেখেছে। সুতরাং যে জিনিসটা এসেছে সেটি তাদের শেষ পরিণতির পূর্ব মুহূর্ত বা লক্ষণ।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশের জন্য ঘোষিত নতুন ভিসা নীতি অবশ্যই একটি চাপ। এই চাপ তারা সরাসরি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে না দিয়ে এখন তারা এমন একটি অবস্থা তৈরি করে রেখেছে যে, এটা কিন্তু একটা ব্যাপক এবং সীমাহীন পলিসি হয়ে গেল। যে কারও ওপর কিন্তু তার ভূমিকার জন্য এই ভিসা নীতি প্রয়োগ করা যেতে পারে বা তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ থেকে বিরত করা যেতে পারে। আগের ব্যবস্থায় আমরা জানি যে, এ কয়টা মানুষের ওপর স্যাংশন আছে; কিন্তু এখন আমরা বুঝতে পারব না। যে কেউ এটার মধ্যে পড়ে যেতে পারে। তারা যাকেই এটার মধ্যে আছে বলে সন্দেহ করবে তার ওপরই এটা প্রয়োগ করতে পারবে। তিনি আরও বলেন, কাজেই এটা একটা সীমাহীন এবং ব্যাপক ক্ষেত্র ধরে তারা নীতিটা দিয়েছে। এখানে মেসেজটাও বেশ শক্তিশালী বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। এটা বুঝতে হবে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম স্তম্ভ হলো সারা পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে তারা কাজ করছে। যাতে এটা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য তারা অন্যকে উৎসাহিত করতে চায়।
ঊর্ধ্বতনদের হুকুমে কারচুপি করলেও ভিসা বন্ধ: বাংলাদেশিদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিতে পরিবর্তন আনার পর কিছু প্রশ্নের উত্তর জানিয়েছে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস। গত বুধবার রাতে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ওয়েবসাইটে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়।
বিধিনিষেধ কার বা কাদের জন্য প্রযোজ্য হবে-এমন প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে, এ নীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত যে কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অন্য অনেকের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান বা সাবেক কর্মকর্তা/কর্মচারী, সরকারের সমর্থক এবং বিরোধীদলীয় সদস্যরা এর অন্তর্ভুক্ত। এমনকি এ ধরনের ব্যক্তিদের নিকটতম পরিবারের সদস্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে। নিকটতম পরিবারের সদস্য হিসেবে মা, বাবা, স্ত্রী ও সন্তানদের বোঝানো হয়ে থাকে বলে দূতাবাসের কনস্যুলার সেবায় জড়িত এক কর্মকর্তা জানান।
এখন কি এই নীতিমালার আওতায় কোনো ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে কি না-প্রশ্নের জবাবে বলা হয়, না। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেমনটা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে অঙ্গীকারবদ্ধ। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকারকে আমরা স্বাগত জানাই।