ডা. জাফরুল্লাহ চৌধূরীর দাফন আজ
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৬:২৫ এএম, ১৫ এপ্রিল ২০২৩ শনিবার
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জানাজায় বিপুল জনসমাগম
আজকাল ডেস্ক
রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটায় এখানে ডা. জাফরুল্লাহর তৃতীয় জানাজা হয়। জানাজায় বিপুল মানুষের সমাগম ঘটে। এর আগে মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আনা হয়। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় মিনিটে তাঁর মরদেহ বারডেম হাসপাতালের হিমঘর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে আনা হয়। শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে তার কফিনে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। সকাল ১০টা ২০ মিনিট থেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শুরু হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গত মঙ্গলবার ১১ এপ্রিল ধানমন্ডি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে প্রথমে রাজধানীর ধানমন্ডির বাসায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রথম জানাজা হয়। দ্বিতীয় জানাজা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। আজ সকাল দশটায় শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ নেওয়া হবে সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। জুমার নামাজ শেষে সেখানে জানাজা হবে। এবং এর পওে সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেইন গেইটের বাম পাশে তাকে কবর দেয়া হবে। বৃহস্পতিবার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রেস উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু এ তথ্য জানান। তিনি জানান, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর একমাত্র ছেলে বারিশ চৌধুরীর ও তার পরিবারের সিন্ধান্ত অনুযায়ী আজ শুক্রবার বাদ জুমা সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেইন গেইটের বাম পাশে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে কবর দেয়া হবে। এদিন সকাল ১০টা হতে বেলা ১২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত সর্ব সাধারণের জন্য মরদেহ দেখার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
বিভিন্ন দল ও সংগঠনের শোক :
ডা. জাফরুল্লাহর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শোক জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তার শোকবার্তায় বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ, ওষুধ শিল্প ও জনস্বাস্থ্য খাতে ডা. জাফরুল্লাহর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এক বার্তায় বলেন, গরিবের ডাক্তারখ্যাত জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দেশপ্রেম তাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বাংলাদেশ জাফরুল্লাহর মতো ত্যাগী মানুষের অপেক্ষায় থাকবে।
ডা. জাফরুল্লাহকে অত্যন্ত স্পষ্টবাদী উল্লেখ করে শোকবার্তায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রের সব সংকটে তিনি এগিয়ে এসেছেন অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে। আওয়ামী সরকারের গণতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপ এবং ভোটাধিকার হরণের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে তিনি অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন এবং দুর্নীতি, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার।
এ ছাড়া শোক জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকসহ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, গণফোরামের ড. কামাল হোসেন ও ডা. মিজানুর রহমান, দলটির অপরাংশের মোস্তফা মোহসীন মন্টু ও সুব্রত চৌধুরী, সিপিবির মোহাম্মদ শাহ আলম ও রুহিন হোসেন প্রিন্স, জেএসডির আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) এম হাফিজ উদ্দিন খান ও ড. বদিউল আলম মজুমদার, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হক নুর, ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু ও হাবিবুর রহমান রিজু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ূম, জাতীয় পার্টির (জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার ও আহসান হাবিব লিংকন, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বিএমএলের শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী, জাতীয় দলের সৈয়দ এহসানুল হুদা, বাংলাদেশ এলডিপির শাহাদাত হোসেন সেলিম, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, জাকের পার্টির মোস্তফা আমীর ফয়সল, বাংলাদেশ ন্যাপের জেবেল রহমান গাণি ও গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া, দলটির অপরাংশের এমএন শাওন সাদেকী ও ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল বারিক, জাগপার খন্দকার লুৎফর রহমান ও এস এম শাহাদাত, এনডিপির খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা ও মঞ্জুর হোসেন ঈসা, অপরাংশের কারি আবু তাহের, বিপিপির বাবুল সরদার চাখারী ও আব্দুল কাদের, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি মুরসালিন নোমানী ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল, ‘আশা’র প্রেসিডেন্ট আরিফুল হক চৌধুরী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ডা. ফওজিয়া মোসলেম ও মালেকা বানু, এএলআরডির শামসুল হুদা, নারী পক্ষের রেহেনা সামদানী প্রমুখ নেতৃবৃন্দও শোক জানান।
একাত্তরে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় আত্মনিয়োগকারী ডা. জাফরুল্লাহর পরে বড় অবদান ছিল জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়নে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তুলে কম খরচে দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করায়ও তার অবদান স্মরণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শ পাওয়া জাফরুল্লাহ রাজনৈতিক অঙ্গনেও নানা ভূমিকা রেখে চলছিলেন। তবে এই সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিতি গড়ে উঠেছিল তার। অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করায় দলটির নেতাকর্মীরাও কয়েক মাস ধরে তাকে এড়িয়ে চলতেন। খুবই সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন একজন ভাস্কুলার সার্জন। তিনি মূলত জনস্বাস্থ্য চিন্তাবিদ। বহির্বিশ্বে তার পরিচয় বিকল্প ধারার স্বাস্থ্য আন্দোলনের সমর্থক ও সংগঠক হিসেবে।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানের কোয়েপাড়া গ্রামে। তার বাবা হুমায়ন মোর্শেদ চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা হাছিনা বেগম চৌধুরী ছিলেন গৃহিণী। মা-বাবার ১০ সন্তানের মধ্যে জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন সবার বড়। ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন তিনি। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষা নিতে তিনি যুক্তরাজ্যে গেলেও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পড়াশোনা বাদ রেখে দেশের টানে ছুটে আসেন। লন্ডন থেকে ফিরে ভারতের আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রথমে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন জাফরুল্লাহ, পরে সেখানেই ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় আত্মনিবেদিত হন।
স্বাধীনতার পর মেলাঘরের সেই ফিল্ড হাসপাতালকে ঢাকার ইস্কাটনে নিয়ে আসেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী, পরে গ্রামকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুরূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘চল গ্রামে যাই’Íএই স্লোগান নিয়ে হাসপাতালটি সাভারে স্থানান্তরিত হয়। তখন এর নামকরণ হয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। স্বাধীনতার পর নারীর ক্ষমতায়নে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রায় অর্ধেক কর্মী নেওয়া হয়েছিল নারীদের মধ্য থেকে। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৭৯ সাল থেকে জাতীয় শিক্ষা কমিটি ও নারী কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৮২ সালে প্রণীত জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়নে অবদান রাখেন তিনি।
১৯৭৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এশিয়ার নোবেল পুরস্কার হিসেবে পরিচিত ‘র্যামন ম্যাগসাইসাই’ পুরস্কার তিনি পান ১৯৮৫ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি ইউনিভার্সিটি ২০০২ সালে তাকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ হিসেবে সম্মাননা দেয়।
