প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে না
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৬:১৮ এএম, ১৫ এপ্রিল ২০২৩ শনিবার
মোমেনের সাথে বৈঠকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তাগিদ ব্লিঙ্কেনের
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেসব্রিফিং
আজকাল রিপোর্ট
জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে যে বক্তব্য রেখেছেন তা দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছে। তবে তার এই বক্তব্য দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের সাপ্তাহিক ব্রিফিং-এ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা তার পুত্র প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী মন্তব্য দু’দেশের মধ্যকার বিদ্যমান সম্পর্কে কোন প্রভাব ফেলবে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি বলেন, আমরা তো যুক্তরাষ্ট্রে বৈঠক করে এলাম। আমাদের যে সব এজেন্ডা ছিল সবই সুন্দরভাবে আলোচনা করে এসেছি।
উল্লেখ্য, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সাথে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের বৈঠকের প্রাক্কালে জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্যী শেখ হাসিনা বলেন, যুযক্তরাষ্ট্র চাইলে যে কোন দেশের ক্ষমতা পাল্টে দিতে পারে। তিনি বলেন, তারা দূর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, আবার দূর্নীতির কারণে সাজাপ্রাপ্তদের পক্ষ হয়েই তারা ওকালতি করে। জাতীয় সংসদের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে গত সোমবার অনুষ্ঠিত এই বিশেষ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান, বঙ্গবন্ধুর খুনীকে ফেরত না দেয়া প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কথা বলেন। তার বক্তৃতার বড় একটি অংশ জুড়েই ছিল যুক্তরাষ্ট্র প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে এমন একটি সরকার আনতে চাচ্ছে যার গণতান্ত্রিক কোন অস্তিত্ব থাকবে না। এই বক্তৃতাতেই তিনি প্রথম আলো পত্রিকার সমালোচনা করে বলেন, প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, গণতন্ত্রেও শত্রু, দেশের মানুষের শত্রু। এ প্রসঙ্গে তিনি নাম না নিয়ে একজনের উল্লেখ করে বলেন, আর এদেও সঙ্গে রয়েওেছ একজন বড় সুদখোর। সে বড়ই প্রিয় আমেরিকার। আমেরিকা একবারও জিজ্ঞাসা করে না, সরকারের বেতন তুলত যে এমডি সে এত মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কোথা থেকে পেল।
প্রধানমন্ত্রী এমন এক সময়ে এ বক্তব্য দিলেন যখন ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের সাথে পররাষ্ট্রম›ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বহুল প্রতীক্ষিত বৈঠকে বসছেন। বৈঠকের সূচনাতেই দেশের অত্যাসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য করার নিশ্চয়তা চাইলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি জে ব্লিঙ্কেন। বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয় সারা বিশ্ব আগামী নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। অবশ্য আমরাও তাকিয়ে আছি, যাতে বাংলাদেশ এই অঞ্চল ও বিশ্বের জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের শক্তিশালী উদাহরণ তৈরি করতে পারে। জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন তাঁর ওপেনিং স্টেটমেন্ট বা উদ্বোধনী বক্তব্যে এ নিয়ে কিছু না বললেও হোটেলে ফিরে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়ার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সব দলের অংশ গ্রহণে একটি অবাধ, স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য তথা ‘মডেল’ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেয়ার কথা জানান।
ওয়াশিংটন সময় সোমবার দুপুর দেড়টায় মোমেন-ব্লিঙ্কেন কাক্সিক্ষত বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ মিশনের রিপোর্ট মতে, আধ ঘণ্টারও কম সময় স্থায়ী ছিল দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটি। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কয়েক মিনিটের সূচনা বক্তব্যের রেকর্ডটি এরই মধ্যে প্রচার করেছে স্টেট ডিপার্টমেন্ট। প্রচারিত ভিডিওতে শোনা যায়, সূচনা বক্তৃতায় ব্লিঙ্কেন বলছেন, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি অবশ্যই অবাধ এবং সুষ্ঠু হতে হবে। শুধু বাংলাদেশ নয় বরং আন্তর্জাতিকভাবেও নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য হওয়ার তাগিদ দিয়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের শুরুতেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন,এটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক দৃঢ় করার গুরুত্বের পাশাপাশি উঠে আসে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গও। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশ এবং দেশের জনগণকে সাধুবাদ জানিয়ে ব্লিঙ্কেন বলেন, বাংলাদেশ ১০ লক্ষ রোহিঙ্গাকে উদারতার সঙ্গে যেভাবে আশ্রয় দিয়েছে সেটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। দুই দেশের সম্পর্ক আরও মজবুত করার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মানবাধিকার এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে জোর দেন তিনি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য শেষে সূচনা বক্তব্য দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তি অত্যন্ত মজবুত উল্লেখ তিনি বলেন, বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বহুমাত্রিক এবং গতিশীল, যা বিগত ৫০ বছরে ধাপে ধাপে বিকশিত হয়েছে। মন্ত্রী মোমেন বলেন, আমরা চাই সামনের ৫০ বছর এবং তারপরেও যেন এটি আরও বৃদ্ধি পায়। গত স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন। সেই চিঠি দু'টির অংশবিশেষ বৈঠকে তুলে ধরেন মোমেন। বাংলাদেশের সরকার প্রধানকে লেখা মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিঠির সমাপনীতে মুক্তিযুদ্ধের সর্বজনীন শ্লোগান ‘জয় বাংলা’ উল্লেখ থাকার বিষয়টি বিশেষভাবে তুলে ধরেন মোমেন। সেই সঙ্গে বাইডেনের চিঠির জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি চিঠি বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দিয়েছেন জানিয়ে মোমেন বলেন, বৈঠক শেষে আমি তা আপনার কাছে হস্তান্তর করবো। ব্লিঙ্কেনের চিঠিতে বাংলাদেশকে এ অঞ্চলের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে উল্লেখ করে প্রশংসাসম্বলিত যেসব কথা বলা হয়েছে তার প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে মোমেন।
এদিকে বৈঠক শেষে হোটেলে ফিরে স্থানীয় সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন মন্ত্রী মোমেন। বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য তথা মডেল বা আদর্শ নির্বাচন দেখতে চায়। জবাবে আমি বলেছি, আমরাও তাই চাই। তিনি বলেন, আমি বলেছি গণতন্ত্র আমাদের রক্তে মিশে আছে। গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা সমুন্নত রাখতে মানুষ রক্ত দিয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য চেয়ে মোমেন স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এবং স্বচ্ছভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য গৃহীত সরকারি পদক্ষেপের বিস্তারিত তুলে ধরেন। বলেন, আমি বলেছি, বাংলাদেশ মার্কিন পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানায় কিন্তু বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কোনো পক্ষপাতিত্বমূলক পর্যবেক্ষককে নয়। মন্ত্রী মোমেন বলেন, আমি বলেছি- একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিরোধী দলকেও এগিয়ে আসতে হবে। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করছি।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ও শ্রমিকদের অধিকার সমুন্নত রাখা এবং সন্ত্রাসবাদ দূর করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন বলে সাংবাদিকদের জানান মোমেন। বলেন, তিনি মার্কিন মন্ত্রীকে খোলাসা করেই বলেছেন, সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন চায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। সেই সঙ্গে সরকার ও দল আশা করে দেশের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষকে সাহায্য-সহায়তাসহ নানাভাবে তারা খুশি রাখতে পেরেছেন। ফলে আগামী নির্বাচনে সব দল এলেও তারা বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ফের ক্ষমতায় ফিরতে পারবে বলে বিশ্বাস করেন। মন্ত্রী বলেন, এ জন্য আমার সরকার সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য তথা মডেল নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এক প্রশ্নের জবাবে মোমেন বলেন, বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের সেদেশে ফেরত পাঠানো, মার্কিন বিভিন্ন উন্নয়ন-সহায়তা তহবিল থেকে বাংলাদেশে উন্নয়ন-সহায়তা প্রদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করেছি। ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানসহ ব্রিফিং এবং বৈঠকে বাংলাদেশের ৬ সদস্যের প্রতিনিধি দল উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে দেড় মাস আগে ঢাকা সফর করে যাওয়া মার্কিন কাউন্সেলর ডেরেক শেলেসহ স্টেট ডিপার্টমেন্টের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেক্রেটারি অব স্টেটের সঙ্গে ছিলেন।
