মাদকের আন্তজেলা ডিপো চনপাড়া
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০১:৪৫ এএম, ১৪ নভেম্বর ২০২২ সোমবার
মাদকের আন্তজেলা ডিপো হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার চনপাড়া। তিন পাশেই জলবেষ্টিত ভয়ংকর এই গ্রামটি সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ অবহিত হওয়ার পরও বহাল তবিয়তে মাদক ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর পার্শ্ববর্তী হওয়ার পরও মাদকের স্বর্গরাজ্য খ্যাত চনপাড়া থেকেই ইয়াবা, আইস, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদক সরবরাহ হচ্ছে পার্শ্ববর্তী গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে। অন্যদিকে চিহ্নিত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের দিয়েই এই মাদকের ডিপোতে করা হয়েছে ৩৫ সদস্যের মাদক নির্মূল কমিটি। অথচ এখানকার ৫ শতাধিক মাদক ব্যবসায়ীর আশ্রয়দাতা ইউপি সদস্য বজলুর রহমান ওরফে বজলু।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১২৬ একরের এই মাদক সাম্রাজ্যে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে মাঝেমধ্যেই মাদক ব্যবসায়ীরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন। এরা আবার চড়াও হচ্ছে খোদ র্যাব-পুলিশের ওপর। এটা সত্যি বেমানান। সর্বশেষ ২৭ সেপ্টেম্বরও এমনটা হয়েছে। তাদের পরামর্শ হলো, সরকার-ঘোষিত মাদকে ‘জিরো টলারেন্স’-এর অংশ হিসেবে চনপাড়া নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা করা উচিত। গতকাল সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তাফা রাসেল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বস্তি এলাকা এমনিতেই অনেক ঘিঞ্জি। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লাখের অধিক মানুষের আবাস চনপাড়া। তবে মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। মাঝেমধ্যেই আমরা সেখানে অভিযান চালাই। আর আমি নিজেও এই জেলায় নতুন। চনপাড়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ সম্প্রতি একাধিকবার সরেজমিন চনপাড়ায় গিয়ে এবং একাধিক সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চনপাড়ায় মাদকের ব্যবসা করে অনেকেই আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় নামে-বেনামে রয়েছে তাদের একাধিক ফ্ল্যাট, গাড়ি ও বাড়ি। চিহ্নিত মাদকসম্রাজ্ঞী বিউটি আক্তার ওরফে কুট্টি নিহত হলেও বর্তমানে মেয়ে পারভীন তার হাল ধরে রেখেছেন। বিউটি-হাসান দম্পতির শতকোটি টাকার সম্পত্তি পারভীন নিজেই দেখভাল করছেন। মাদক ব্যবসায়ীদের অন্তঃকোন্দলে নিহত হওয়া আনোয়ার মাঝির খোদ চনপাড়াতেই রয়েছে পাঁচটি প্লট। তিনি নিজে কোটি টাকার প্রাডো গাড়িতে চলাচল করতেন। কুমিল্লা ও চাঁদপুরে গড়েছেন বিশাল সম্পত্তি। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে মাদক ব্যবসায় রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছেন রিতা নামের একজন। তার নিজের ব্যবহারের জন্য রয়েছে দুটি এলিয়েন গাড়ি। মাদকের পাশাপাশি সুন্দরী রমণীদের নিয়ে রয়েছে তার স্কট সার্ভিস। মাদক ব্যবসায় নিরঙ্কুশ প্রভাব বিস্তার অব্যাহত রাখতে অনেক প্রভাবশালীকে নিজে চাহিদা অনুযায়ী সার্ভিস দিয়ে আসছেন। তবে চনপাড়ার ২৫ জন শীর্ষ মাদকের ডিলারেরই মাথার ছায়া হিসেবে কাজ করছেন ইউপি সদস্য বজলুর রহমান ওরফে বজলু। নৌ ও স্থলপথ এবং নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। চনপাড়ার বেশির ভাগ মাদকের চালান আসে জলপথে। লবণের ট্রলার, বালুর বাল্কহেডকেই বেশি পছন্দ মাদক ডিলারদের। আবার অভিজাত গাড়ির মাধ্যমে দিনের আলোতে আনে তারা মাদকের বড় বড় চালান। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের নজরদারি এড়াতে এসব গাড়িতে অনেক সময় সরকারি বিভিন্ন দফতরের স্টিকার ব্যবহার করেন মাদক ব্যবসায়ীরা। চনপাড়ার একজন মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারটা কোনোভাবে পার হওয়ার বিষয়কেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর পরের পথ চনপাড়ার ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। তবে নিরাপদ হিসেবে জলপথকেই বেশি পছন্দ তাদের।
শীর্ষ ২৫ মাদক ব্যবসায়ী : চনপাড়ায় শীর্ষ ২৫ জনের কাছ থেকে মাদক সংগ্রহ করে ব্যবসা করছে অন্তত ২০০ জন। আবার তাদের কাছ থেকে আরও ২৫০ জন খুচরা ব্যবসা করছে। শীর্ষ ২৫-এর অন্যতম হলেন বজলুর তিন ভাই বোতল মিজু, গুটি কাশেম ও পাউডার হাসান, মেয়ের জামাই রিপন এবং বড় মেয়ে সুমা। ৯ নম্বর ওয়ার্ডে রয়েছেন শাহ আলম, স্বপন বেপারী ওরফে বোটলার স্বপন, দেলোয়ার, মিল্লাত ওরফে খুনি মিল্লাত, ডাকাত মোস্তাফা, ফেন্সি ফারুক, লাকি, রিতা, পারভীন, বিয়ার সুমন, জাকির, রাসেল, গন্ডা বিল্লাল, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পলাশ, আরব আলী।
মাদক নির্মূল কমিটিতেও ওরা : মাদকের অভয়ারণ্য বন্ধ করতে এক বছর আগে চনপাড়ায় মাদক নির্মূল কমিটি করা হয়। তবে কমিটির শীর্ষ ব্যক্তিদের বেশির ভাগই চিহ্নিত মাদক কারবারি। গত বছর নভেম্বর মাসে ৩৫ সদস্যের মাদক নির্মূল কমিটি করে দেন ইউপি সদস্য বজলু। অথচ তার মেয়ের জামাই রিপন অক্টোবরে মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে। স্থানীয়রা বলছেন, কমিটির আহ্বায়ক রাজু আহমেদ ওরফে রাজা চিহ্নিত মাদক কারবারি। তার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলাও রয়েছে। আর মাদক নির্মূল কমিটির দুই যুগ্ম-সচিব ফাহাদ আহম্মেদ ও স্বপন ব্যাপারীও তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি। বৃহস্পতিবার চনপাড়ায় র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত শাহীনুর রহমান ওরফে সিটি শাহীন ছিলেন চনপাড়া মাদক নির্মূল কমিটির সদস্যসচিব। তার বিরুদ্ধে হত্যা, মাদক-সংশ্লিষ্টতাসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৩টি মামলা ছিল। জানা গেছে, খোদ নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের খাতাতেই উল্লেখ রয়েছে চনপাড়ায় ১১৪টি মাদক স্পটের বিষয়টি। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত ৪৪ বছরে এখানে ২৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর বেশির ভাগ মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তবে বাসিন্দাদের মতে, হত্যার ঘটনা আরও অনেক বেশি। বৃহস্পতিবার দুপুরে মাদক উদ্ধার অভিযানে র্যাব সদস্যদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শাহীনুর রহমান ওরফে সিটি শাহীন নিহত হওয়ার পর থেকে কিছুটা স্থবিরতা এসেছে চনপাড়ায়। তবে কয়েক দিনের মধ্যেই আবারও মাদক ব্যবসায়ীদের প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে বলে মন্তব্য নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চড়পাড়ার অনেক বাসিন্দার।
বৃহস্পতিবারের আগ পর্যন্ত চনপাড়ার যে কোনো জায়গায়ই পাওয়া যাচ্ছে নানা ধরনের মাদক। এখান থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় হোম সার্ভিস হিসেবে মাদক পাঠানো হয়। তবে সন্ধ্যা নামতেই রাজধানীসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষার্থীসহ নানা পেশার বিপুলসংখ্যক মানুষ মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ও সিএনজি অটোরিকশাযোগে এই মাদকের হাটে যান। অনেকে সেবনের পাশাপাশি বহনও করেন মাদক। পুলিশের একশ্রেণির কিছু কর্মকর্তা নিয়মিত মাসোহারা পাওয়ার কারণে অভিযানের কিংবা স্পর্শকাতর ও গোপনীয় খবর মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে আগেই পৌঁছে দেন। অনেকে মোটা অঙ্কের টাকা এবং তদবির করে সেখানে পোস্টিং নেন। অতীতের মতো চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রটি এখনো পেশাদার কিলারসহ ভয়ংকর অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
জানা গেছে, চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের দুই গ্রুপের দুজন নেতা। তাদের একজন জয়নাল আবেদীন বর্তমানে কারাগারে। এর আগে অপর নেতা আনোয়ার হোসেন প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন। তখন অন্য দুই গ্রুপের নেতা সাদ্দাম হোসেন ও রাজা মিয়া নিরাপদে আশ্রয় নেন। হত্যা মামলার আসামিরা এতই ভয়ংকর যে তাদের বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষী দেওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। তাই সাক্ষীর অভাবে হত্যা মামলাগুলোর বিচার হচ্ছে না।
