অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কায় বাংলাদেশ
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৫৬ এএম, ১২ নভেম্বর ২০২২ শনিবার
মাসুদ হোসেন, ঢাকা থেকে
আগামী বছর অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কায় রয়েছে বাংলাদেশ। এই আশঙ্কার কারণে এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতির বিরূপ প্রভাবে সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকারী অর্থে বিদেশ সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমশ কমছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, রিজার্ভের যে হিসাব দেখানো হচ্ছে সেই হিসাব পদ্ধতির সঙ্গে তাদের দ্বিমত রয়েছে। রিজার্ভ না থাকায় অনেক ব্যাংকই এখন এলসি খুলছে না। ফলে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি রীতিমত বন্ধ। শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি বন্ধ। উৎপাদন ব্যহত হওয়ায় রফতানি আয়েও ভাটা পড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়িয়ে দেয়ায় মানুষ এখন ডলারের ওপর বিনিয়োগ করছে। ফলে বিশ্বব্যাপি ডলারের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যের শতকরা আশি ভাগ ডলারে সম্পন্ন হয় ডলারে। তাই ডলারের পর্যাপ্ত রিজার্ভ না থাকলে সংকটে পড়তে হয়। প্রবাসী কর্মীদের মধ্যে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণের প্রবণতা রয়েছে। এতে করে রফতানি আয় কমে যাচ্ছে। রেমিটেন্স ও রফতানি থেকেই মূলত বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। এখন এই দুই খাতের নিম্নমুখী প্রবণতায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ আরও কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অবশ্য আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ মঞ্জুর করবে বলে অনুমোদন দিয়েছে। ঋণের প্রথম কিস্তি ৬৭ কোটি ডলার আইএমএফ ফেব্রুয়ারিতে পরিশোধ করবে। তারপর প্রতি ছয় মাস পর পর কিস্তি দেবে। ডলার সংকটের মধ্যে আইএমএফের সহায়তা কাজে লাগবে বলে মনে হচ্ছে। তবে সংকটের মাত্রা অনেক গভীর।
দেশে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটও প্রকট হচ্ছে। আর্ন্তজাতিক বাজারে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে গ্যাসের চাহিদা মেটানো হয় মূলত দেশে উৎপাদন এবং বাইরে থেকে এল্এমজি আকারে আমদানির র্কা হয়। বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন, বাণিজ্যিক হোটেল, সিএনজি স্টেশন, চা বাগান, গৃহস্থালী প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশে গ্যাস ব্যবহার করা হয়। শিল্প-কারখানায় দুইভাবে গ্যাসের ব্যবহার হয়। প্রথমত জেনারেটর চালনা, দ্বিতীয়ত কারখানার বয়লার চালানোর জন্য গ্যাসের ব্যবহার হয়। এখন গ্যাসের স্বল্পতায় এসব ক্ষেত্রে গ্যাসের ব্যবহার সীমিত করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। সার কারখানায় উৎপাদন কমায় কৃষিতে বিরুপ প্রভাব পড়তে পারে।
বাংলাদেশ একমাত্র কাতার থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি করে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির বিশেষ দিক হলো, গ্যাসের দাম যত বাড়–ক কিংবা কমুক একটা সুনির্দিষ্ট দামে ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত এলএনজি সরবরাহ করা হবে। বাংলাদেশে এভাবে এলএনজি আমদানি নিয়ে বিতর্ক হয়েছিলো। কারণ স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম কম ছিলো। ফলে স্পট মার্কেট থেকে না কিনে কেন দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে আমদানি করা হচ্ছে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিলো। এখন দেখা যাচ্ছে, স্পট মার্কেটে দাম বেশি। তবে আশার কথা হলো, ব্রুনাইয়ের সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ বাংলাদেশ সফর করে যাওয়ার পর দেশটি বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি সরবরাহ করার প্রস্তাব করেছে। ব্রুনাই বলেছে, প্রতি মাসে তারা একটি চালান বাংলাদেশে পাঠাতে পারবে। ১০ থেকে ১৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় এটি করতে হবে। বাংলাদেশে স্থলভাগ ও সমুদ্র পৃষ্ঠে গ্যাসের অনুসন্ধান খুব বেশি হয়নি। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ব বাপেক্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন কোম্পানী দেশের অভ্যন্তরে গ্যাস উত্তোলন করে থাকে। শেভরন একাই বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ গ্যাসের ৫৫ ভাগ জোগান দিয়ে থাকে।
খরার কারণে বাংলাদেশে আমন ধান উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা পুরা হওয়ার সম্ভাবনা কম। সেচ দিয়ে কেউ কেউ আমন ফসল রোপন করেছিলো। মওসুমের শেষ দিকে অবশ্য বৃষ্টিপাত হওয়ায় আশার সঞ্চার হয়েছে। তবে বাংলাদেশ মূলত ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করে থাকে। যুদ্ধের কারণে সেখান থেকে গম আমদানি সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্বে খাদ্যে ঘাটতি থাকলে প্রতিবেশি ভারত সাধারনত খাদ্যশস্য রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালে সংকটের আশঙ্কায় সবাইকে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরাও একই ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে রাজনীতির পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। বিরোধী নেতারা বলছেন, মার্চ মাস নাগাদ অর্থনীতি বেশ সংকটে পড়বে। নির্বাচনের আগের বছর অর্থনীতির ওপর এই অভিঘাত শেখ হাসিনার সরকারকে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পাওে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
