বুধবার   ১৯ নভেম্বর ২০২৫   অগ্রাহায়ণ ৫ ১৪৩২   ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

বাংলাদেশে আমলাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ

অবসরের তালিকায় আরো কর্মকর্তা

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০৩:৫৮ এএম, ২২ অক্টোবর ২০২২ শনিবার



মাসুদ হোসেন, ঢাকা থেকে
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় বাংলাদেশে আমলাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে তথ্য সচিব মকবুল হোসেনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পর বিষয়টি নিয়ে আলোড়ন হয় সবচেয়ে বেশি। গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে আরও অন্তত পাঁচজন সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর খবর বের হয়েছে। বিষয়টি আমলাদের মধ্যে আতঙ্কেরও সৃষ্টি করেছে। বর্তমান সরকারকে অনেকে আমলা নির্ভর সরকার বলে থাকেন। এখন আমলাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা দেখে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
ডিসি ও এসপিদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে একজন কমিশনারের মন্তব্য নিয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিলো। নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান ডিসি ও এসপিদেরকে ‘নপুংশক’ এবং ‘নখদন্তহীন’ বলে মন্তব্য করার পর সভায় বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। ডিসি ও এসপিদের আপত্তির কারণে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান তার বক্তব্য বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল ওই অনুষ্ঠানে ডিসি ও এসপিদের দলীয় কর্মীর মতো আচরণ না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার কিছুদিনের মধ্যে গাইবান্ধায় সংসদীয় উপ নির্বাচনের সময় প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিজের্ইা ভোট দিয়েছেন বলে নির্বাচন কমিশন সিসিটিভির মাধ্যমে দেখতে পান। এই দৃশ্য দেখার পর নির্বাচন কমিশন থেকে গাইবান্ধার প্রশাসনকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন নির্বিকার থাকায় নির্বাচন স্থগিত না করে কোন উপায় নির্বাচন কমিশনের ছিলো না বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মন্তব্য করেছেন। এ প্রসঙ্গে পর্যবেক্ষক মহল বলছেন,  নির্বাচন কমিশন ও মাঠ প্রশাসনের মধ্যে চলমান সম্পর্ক ইতিবাচক নয়। নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান যে ভাষা প্রয়োগ করেছেন সেটা আপত্তিকর। প্রতিষ্ঠানগুলো পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধাশীল না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না।
নির্বাচন কমিশন বনাম মাঠ প্রশাসনের মধ্যে দূরত্ব ঘুচতে না ঘুচতেই তথ্য সচিব মকবুল  হোসেনকে সরকার বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠালো। অনেক সাবেক আমলাই সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। তারা বলছেন, কারণ দর্শানোর নোটিশ না দিয়েই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো সমীচীন নয়। যদিও বিদ্যমান আইনে সরকার কোন কারণ ছাড়াই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর এখতিয়ার রাখে। মকবুল হোসেনকে ঠিক কী কারণে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। তবে কোন কোন মিডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তাকে অবসরে পাঠানো হয়। কেউ কেউ বলছেন, বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কারণে তাকে অবসরে পাঠানো হয়। আবার কেউ কেউ বলছেন, তার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাওয়ায় তাকে অবসরে যেতে হয়েছে। কেউ আবার বলেছেন, ইদানিং বেসরকারি টিভিতে বিএনপির কাভারেজ বেড়ে যাওয়ায় তথ্য সচিবকে ব্যর্থ বলে মনে করছে সরকার।
মকবুল হোসেন অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, আর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কোনও দুর্নীতির সঙ্গে তিনি জড়িত নন। নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নের সময় থেকে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন দাবী করে তিনি বলেছেন, তার বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক রাখার প্রশ্নই ওঠে না।
মকবুল হোসেনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পর একটি মিডিয়ায় গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে খবর বের হয় যে, বেশ কিছু আমলা গোপন বৈঠক করে সরকার বিরোধিতায় নামার কারণে আরও অন্তত পাঁচজন সচিবকে বাধ্যতামুলক অবসরে পাঠানো হতে পারে। একই দিন সন্ধ্যায় সরকার বিরোধী হিসাবে পরিচিত তিনজন এসপি মর্যাদার কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এই তিন কর্মকর্তার একজনের সমান ব্যাচের কর্মকর্তারা অতিরিক্ত আইজিপি হয়ে গেছেন। কিন্তু বিএনপি কানেকশনের অভিযোগে তাদের কোন প্রমোশন হয়নি। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে অবসরে পাঠানো হলো।
আমলাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর এই প্রবণতায় গোটা আমলাতন্ত্রে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে কাউকে বিএনপি-জামায়াত বলে রঙ দিতে পারলে তার আর রক্ষা নেই। ফলে পেশাদার দক্ষ আমলাতন্ত্র গড়ে তোলার স্বপ্ন ধুলিসাৎ হতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন, নির্বাচনের আগে আমলাতন্ত্রকে পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টার অংশ হিসাবে সরকারের এই পদক্ষেপ। এই ধারায় ভবিষ্যতে আরও অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে। এতে করে আমলাতন্ত্র লেজুড়বৃত্তিতে জড়িয়ে যাবে। আবার অনেকে মনে করেন, নির্বাচনের আগে সরকারের এমন পদক্ষেপ আমলাতন্ত্রে ক্ষোভের সৃষ্টি করতে পারে। এতে করে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর নাগাদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নানা কৌশল অবলম্বন করছে। নিজেদের জোট বাড়ানোর চেষ্টা করছে উভয় দল। এছাড়াও, ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে আমলাতন্ত্র, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিদেশী কূটনীতিক প্রভৃতির কাছে ধর্ণা দিচ্ছে দুই দল। তার বেশির ভাগই পর্দার আড়ালে ঘটছে। আবার কিছু কিছু প্রকাশ্য হয়ে পড়ছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতা বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে আগামী নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু, অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য হবে সেই চ্যালেঞ্জ দিনের পর দিন নতুন করে সাধারন মানুষের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে।
বেসামরিক আমলা ও পুলিশ প্রশাসন নিয়ে সরকারের পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ কোথায় তা বোঝা কষ্টকর। তবে এ বছর নির্বাচনে ফ্যাক্টর কী হবে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। কেউ কেউ মনে করেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব বিশেষ করে ভোটের আগে সরকারের জন্যে বিশাল এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। এই চ্যালেঞ্জ সরকার তার উন্নয়ন প্রচারণার মাধ্যমে মোকাবেলার চেষ্টায় কতটা সফল হবে তাই এখন দেখার বিষয়।।