জ্বালানি সংকটে বাড়ছে লোডশেডিং
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:২৭ এএম, ১১ অক্টোবর ২০২২ মঙ্গলবার
দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে জনজীবন। স্থবির হয়ে গেছে শিল্পের চাকা, বাণিজ্যের রথ। রাজধানী ঢাকা শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকা—সব জায়গাতেই বেড়েছে লোডশেডিং। গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুত্হীন থাকছেন গ্রাহকরা। এলাকাভেদে দিনে তিন থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত তারা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। শিগিগরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে এমন আশ্বাসও দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি সংকটের কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দেশীয় জ্বালানি আহরণ সক্ষমতা ও মজুত না বাড়ানোর এবং আমদানি নির্ভরতার কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখন মার্কিন ডলারের চড়া দরের কারণে নগদ অর্থের অভাবে পড়েছে সরকার। বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাসের দামও বাড়তি। তাই অর্থ সংকটের কারণে চাইলেও আমদানি বাড়ানো যাচ্ছে না। বরং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) ও জ্বালানি তেল আমদানি কমাতে হচ্ছে।
দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা, চাহিদা এবং সঞ্চালন ও বিতরণ পরিস্থিতির তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) দৈনিক প্রতিবেদনে। ঐ প্রতিবেদনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, জ্বালানি সংকট (গ্যাস, ফার্নেস অয়েল, ডিজেল, কয়লা), ইঞ্জিনে-যন্ত্রপাতিতে সমস্যা এবং রক্ষণাবেক্ষণের কারণে বন্ধ থাকায় গত রবিবার দেশে চালু থাকা ১৫০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ৪৫টি কেন্দ্রে কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়নি। এর বাইরেও জ্বালানির অভাবে ৪২টি কেন্দ্র সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি। গ্যাস না পেয়ে আটটি কেন্দ্র এবং জ্বালানি তেল না পেয়ে দুটি কেন্দ্র চালুই করা যায়নি। ৩১টি কেন্দ্রের ইঞ্জিনে সমস্যার কারণে সক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদন হয়েছে।
কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ২১ হাজার ৭১০ মেগাওয়াটের বিপরীতে দিনে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। সব মিলিয়ে এ দিন ২৫ কোটি ২৭ লাখ ৫৯ হাজার ২২ ইউনিট (কিলোওয়াট) বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। সঞ্চালন ও বিতরণে প্রায় ১১ শতাংশ সিস্টেম লস বাদে বাকি বিদ্যুৎ গ্রাহকরা ব্যবহার করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা প্রায় ১৬ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ বর্তমানে সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। তবে পিডিবির রবিবারের দৈনিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি ছুটি থাকা দিনটিতে পিক আওয়ারে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৪৫২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে ১২ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এ দিনে সর্বনিম্ন চাহিদা ছিল ৯ হাজার ৭০৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এ দিন সাবস্টেশন পর্যায়ে ১২ হাজার ৮২৬ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ১১ হাজার ৮৪১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। অর্থাৎ লোডশেডিং হয়েছে ৯৮৫ মেগাওয়াট। পিডিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ দিন শুধু ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে লোডশেডিং হয়েছে। বাকি চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল এবং রংপুর অঞ্চলে কোনো লোডশেডিং হয়নি। কিন্তু ইত্তেফাকের জেলা প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, এই অঞ্চলের জেলাগুলোতে এ দিন গ্রাহক পর্যায়ে দুই থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে।
চলমান বিদ্যুৎ-জ্বালানি পরিস্থিতি সম্পর্কে গতকাল সোমবার সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, গ্যাস আনতে না পারায় আগামী নভেম্বর মাসের আগে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতির আশা নেই। লোডের কারণে আমরা দিনের বেলা কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখছি। আবার দিনে যেগুলো চালাচ্ছি সেগুলো রাতে বন্ধ রাখছি। এজন্য লোডশেডিংয়ের জায়গাটা একটু বড় হয়ে গেছে। আমরা চেয়েছিলাম অক্টোবর থেকে কোনো লোডশেডিংই থাকবে না। কিন্তু সেটা আমরা করতে পারলাম না। কারণ আমরা গ্যাস আনতে পারিনি।
তিনি বলেন, বর্তমান সমস্যাটা সাময়িক হতে পারে। তবে আমি মনে করি, বললেই এটা সাময়িক হচ্ছে না। কারণ বিশ্বপরিস্থিতি আবার অন্য রকম করে ফেলে। এই মাসটা (অক্টোবর) একটু কষ্ট করতে হবে। আশা করছি সামনের মাস থেকে পরিস্থিতি আরেকটু ভালো হবে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, শিল্পে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে গেছে। তাই আমরা বিদ্যুতে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছি। আর কমিয়ে দেওয়ার কারণে সমস্যা দেখা দিয়েছে।
সরকারের বিদ্যুৎ খাতের পরামর্শক সংস্থা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, জ্বালানি ও অর্থ সাশ্রয়ে সরকার পরিকল্পিত লোডশেডিং দিয়ে আসছিল। কিন্তু গত ৪ অক্টোবর পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিড ট্রিপ করার পর বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রেও সমস্যা হয়েছে। সে কারণে লোডশেডিং কিছুটা বেড়েছে। আর বিশ্বপরিস্থিতির কারণেই আরো বেশ কিছুদিন আমাদের সাশ্রয়ী নীতিতে চলতে হবে।
পেট্রোবাংলার এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয়ভাবে যতটুকু সম্ভব গ্যাসের জোগান দেওয়া হচ্ছে। এর বেশি আপাতত করা যাবে না। এলএনজি আমদানিও আপাতত বাড়ানো যাবে না বিশ্ববাজারে এই জ্বালানির চড়া দামের কারণে। আগে প্রতি মাসে পাঁচটি করে এলএনজি কার্গো দেশে আসত। গত কয়েক মাস ধরে আসছিল চারটি করে। চলতি অক্টোবর ও আগামী নভেম্বর মাসে আরো একটি করে এলএনজি কার্গো কম আসবে। তবে ডিসেম্বর থেকে আবার পাঁচটি করে এলএনজি কার্গো আসবে। পেট্রোবাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম এলএনজি থেকে রূপান্তরিত গ্যাস জাতীয় পাইপলাইনে আসছে। এলএনজি থেকে গ্যাস সরবরাহ দৈনিক ৩৮ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে, যা আগে ৭৫ থেকে ৮৫ কোটি ঘনফুটে ওঠানামা করত। দেশে বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা ৪১০ কোটি ঘনফুটের বেশি। বিপরীতে গত সোমবার স্থানীয় ও আমদানি মিলিয়ে ২৬১ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। এদিন স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে ২২৯ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে।
তবে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও তড়িৎ প্রকৌশলী অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, সরকারের অতিরিক্ত আমদানিনির্ভরতা এবং বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে অপচয়-দুর্নীতি রোধ না করার কারণেই পরিস্থিতি এত সংকটময় হয়ে উঠেছে। স্থানীয় জ্বালানি অনুসন্ধান কার্যক্রম ব্যাপকভাবে জোরদার করার জন্য গত এক যুগে সরকারের হাতে পর্যাপ্ত সময় ছিল। অনুসন্ধানের মাধ্যমে জ্বালানির স্থানীয় মজুত বাড়ানো গেলে এখনকার সংকটে পড়তে হতো না। বিশ্ববাজারে যখন দীর্ঘদিন তেলের দাম কম ছিল, তার সুবিধাও জনগণ পায়নি। এখন দাম বাড়ায় আমদানি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সত্যিকার অর্থে জ্বালানিতে সরকারের ভুল নীতি ও কাজের খেসারত দিতে হচ্ছে জনগণকে।
