বিমানবন্দরে চুরির ঘটনা থামছে না কেন?
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৫২ এএম, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ রোববার

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীদের লাগেজ চুরি, লাগেজ কেটে মূল্যবান মালামাল চুরি যেন প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অনেকেই আর ফেরত পাচ্ছেন না নিজেদের মালামাল। এর ফলে ভোগান্তি বাড়ছে যাত্রীদের।
বিমানবন্দরে বিদেশ ফেরত যাত্রীদের মালামাল চুরির ঘটনার বিষয়টি সম্প্রতি সাফ নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়া খেলোয়াড়দের ডলার চুরি হওয়ার পর আবারো সামনে এসেছে। মালামাল চুরির বিষয়ে অনেক যাত্রী বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অভিযোগ করে থাকেন।
তবে বন্দরের নির্বাহী পরিচালকের দাবি, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীদের লাগেজ চুরির ঘটনা এক প্রকার অসম্ভব। তার মতে, যাত্রীরা যে বিমানবন্দর থেকে যাত্রা করেন সেখান থেকে এমন ঘটনা ঘটতে পারে।
গত বুধবার দুপুরে বাংলাদেশ বিমানে নেপাল থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন নারী সাফ চ্যাম্পিয়ন ফুটবল দলের সদস্যরা। বিমানবন্দরে নামার পর বাংলাদেশে দলের ফুটবলার কৃষ্ণা রানী সরকার দেখতে পারেন তার লাগেজ ভাঙা। ডলার, টাকা ও উপহারসামগ্রী উধাও।
বাফুফের পক্ষ থেকে জানানো হয়, কৃষ্ণা রানী সরকারের ব্যাগ থেকে ৫০০ ডলার এবং ৫০ হাজার টাকা চুরি হয়েছে। এছাড়া সানজিদা আক্তারের ব্যাগ থেকে ৫০০ ডলার ও শামসুন্নাহারের ব্যাগ থেকে হারিয়েছে ৪০০ ডলার।
ঢাকার বিমানবন্দরে নামার পর লাগেজ না যাওয়া কিংবা লাগেজের ভেতরের মালামাল বুঝে না পাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। সংবাদমাধ্যমে এরকম প্রায়ই যাদের লাগেজ চুরি হয় তাদের ভোগান্তির খবর আসে।
সৌদি প্রবাসী কর্মী এসএম ইসহাক গত ৮ জুলাই তার ৩টি লাগেজের মধ্যে একটি কাটা দেখতে পান। এর ভেতরে থাকা অনেক জিনিস আর পাননি তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাঈদ-সেঁজুতি দম্পতি গত ১০ জানুয়ারি বিমান বন্দরে তাদের লাগেজ হারান। এখনো ফিরে পাননি।
সৌদি প্রবাসী শ্যামল আহমেদ গত বছরের নভেম্বরে দেশে ফেরার সময় বিমান বন্দরে তার লাগেজ হারিয়ে যায়। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তিনি তার মালামাল ফেরত পাননি।
বিমান বন্দরে দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের একটি ফেসবুক গ্রুপ আছে যার নাম ‘ম্যাজিস্ট্রেট, অল এয়াপোর্ট গ্রুপ’। সেখানেও প্রচুর অভিযোগ আসে বলে জানা যায়।
আর গত মাসে সিভিল অ্যাভিয়েশেন এ নিয়ে একটি গণশুনানির আয়োজন করে। সেখানেও তারা প্রচুর অভিযোগ পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
লাগেজ গায়েব বা মালামাল চুরিতে বিমানের কর্মীরা জড়িত। এর প্রমাণও মিলেছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এ চক্রে জড়িত ২০-২৫ জন একাধিকবার সিআইডি এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়নের (এপিবিএন) হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। জানা গেছে, চাকরিচ্যুত হওয়ার পর তাদের কেউ কেউ আবার আইনি কৌশলে বিমানবন্দরে ফিরেছেন।
এদিকে গত এক বছরে বিমান এবং সিভিল অ্যাভিয়েশনের বেশ কয়েকজন কর্মচারীকে হাতেনাতে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানালেও চুরি থামছে না।
নানা পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, বিমানবন্দরে দায়দায়িত্ব মূলত তিনটি বিভাগের। সিভিল অ্যাভিয়েশন, এয়ারলাইন্স এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়নের (এপিবিএন)।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স নিজেদেরসহ সব বিদেশি এয়ার লাইন্সের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব পালন করে।
সিভিল অ্যাভিয়েশেন সার্বিক দায়িত্বে আছে। আর মনিটরিং করে এপিবিএন। বিমান অবতরণের পর মালামাল কনভেয়ার বেল্টে নিয়ে আসার কাজ করে বিমানের হ্যান্ডেলাররা।
তবে প্রতিটি পর্যায়ে মনিটরিংয়ের জন্য সঙ্গে এপিবিএন সদস্যরা থাকেন। আর সবখানেই রয়েছে সিসি ক্যামেরা। এদিকে বিমানন্দরে হারিয়ে যাওয়া মালামাল উদ্ধারের সহযোগিতার জন্য লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড একটি বিভাগ রয়েছে।
একাধিক সূত্র জানায়, কর্মচারীদের মধ্যেই বিমানবন্দরে একটি চোর চক্র আছে। তারা বেশ শক্তিশালী। বিমান বন্দর সূত্র জানায়, প্রতিদিন সেখানকার লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড বিভাগে একশ’রও বেশি অভিযোগ আসে। এগুলোর ৯০ ভাগেরও বেশি চুরির ঘটনা। তবে তার একটি অংশ পরে পাওয়া যায়। নিয়ম হলো পাওয়া না গেলে ২০ কেজি মালামালের জন্য প্রতি কেজিতে ২০ ডলার করে ক্ষতিপুরণ দেয়া হয়। আর তাৎক্ষণিকভাবে ৫০ ডলার ক্ষতিপুরণ দেয়ার নিয়ম আছে। তবে এই ক্ষতিপুরণ পাওয়াও বিশাল এক ঝামেলার ব্যাপার।
এদিকে কোনো যাত্রী যদি হারানো মালামালের জন্য মামলা করতে চান তাহলে তাকে ঢাকার বিমানবন্দর থানায় গিয়ে মামলা করতে হয়। ফলে অনেক যাত্রীই এ বিষয়ে সাধারণ অভিযোগ জানানোর পর আর থানা পুলিশ করতে যান না হয়রানির ভয়ে।
শুধু তাই নয়, চুরির ঘটনা ঘটার পর দায়িত্ব নিয়ে শুরু হয় টানা-হেঁচড়া। যাত্রীরা ঠিক বুঝতে পারেন না কার কাছে গেলে প্রতিকার পাবেন।
বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জিয়াউল হক বলেন, যাত্রীরা প্রতিদিনই লাগেজ চুরি বা কাটার অভিযোগ নিয়ে আমাদের কাছে আসেন। তবে তারা সংখ্যায় কম। আমি ঠিক জানি না তারা বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে না গিয়ে কেন আমাদের কাছে আসেন। হয়তো তারা ওখানে সেবাটা ঠিক মত পান না।
তিনি বলেন, আমাদের কাছে আসলে আমরা তো আর তাদের ফিরিয়ে দিতে পারি না। আমরা সিভিল অ্যাভিয়েশন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়তা করি। আর আমরাও তদন্ত করি। সত্যতা পেলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করি।
তবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বলেন, আমি সাড়ে পাঁচ মাস আগে দায়িত্ব নেওয়ার পর আমাদের বিমান বন্দর থেকে কোনো লাগেজ চুরি বা কাটার লিখিত অভিযোগ পাইনি। আর নারী ফুটবলারদের ঘটনা আমাদের এখান থেকে হয়নি। আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তা নিশ্চিত হয়েছি।
তার দাবী, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সব খানেই সিসি ক্যামেরা ও মনিটরিং আছে। এখানে এই বিষয়গুলো এখন বলতে গেলে অসম্ভব।
তিনি বলেন, যা হয় তা হলো কোনো যাত্রী যে বিমানবন্দর থেকে ফ্লাই করেন সেখান থেকে চুরি হতে পারে। আবার কোনো যাত্রীর লাগেজে কন্ট্রাব্যান্ড কোনো আইটেম থাকতে পারে। তখন সেটাতো তালা মারা থাকলে ওই বিমানবন্দরে কেটে চেক করবে। আবার বক্স করা থাকলে তা ভাঙ্গা হয়।
তার কথা, তারপরও আমাদের কাছে তো অভিযোগ করতে হবে। অভিযোগ না করলে আমরা ব্যবস্থা নেব কীভাবে? আমার আহ্বান যাত্রীদের কাছে তাদের কোনো অভিযোগ থাকলে যেন আমাদের কাছে করেন। আমরা এটার একটা সমাধান করতে চাই। কিন্তু সেটা না করে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই পোস্ট দিয়ে তাদের লাগেজ চুরি বা কাটার কথা জানান।
এ বিষয়ে বিমানবন্দরের লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড বিভাগের ম্যানেজার আমিনুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সৌজন্যে : ডয়চে ভেলে