রোববার   ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আশ্বিন ৫ ১৪৩২   ২৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

ফুলের বাগানে ফুলের সাথে

নিউজ ডেস্ক

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৯:০৮ পিএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮ শুক্রবার

বাসের বিকট ব্রেক ধরার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। হন্তদন্ত হয়ে উঠলাম, দেখি বাসের সামনে গরুর পাল পড়ার দরুন এ অবস্থা। আমি আর মা বিকাল ৪টা নাগাদ রওনা হয়েছি ফুলের রাজধানী যশোরের গদখালীর দিকে। আমাদের সংগঠন শ্রুতির সিলেটের সদস্য সাগর বিশ্বাসের বর্তমান কর্মস্থল যশোরে। অনেক দিন ধরে সাগর বলছিল গদখালীর ফুলের হাটে নিয়ে যাওয়ার কথা। সময় করে উঠতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত নতুন ভ্রমণ গন্তব্যে রওনা হলাম আমি আর মা।

নগরজীবনের ব্যস্ততার সীমারেখা পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। বৃহস্পতিবার অফিসে কাজের খুব চাপ গেছে। তাই ক্লান্তি আমাকে ঘিরে ধরেছে। প্রায় ৭টার দিকে আমাদের গাড়ি যাত্রাবিরতি দেয় উজানভাটিতে। সেখানে বাস থেকে নেমে আমরা কফি খেলাম। বিরতির পর আমাদের পাইলট মহোদয় তুফানবেগে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে চললেন। আমি চোখ বন্ধ করে নিদ্রা দেবীর আশ্রিত হলাম। রাত সাড়ে ১১টার দিকে গাড়ি সায়েদাবাদ গিয়ে কিছু সময়ের জন্য থামল। যান্ত্রিক নগরীতে প্রবেশের পর কিছু সময় গাড়ি এগোতেই চাইছিল না যেন।

রাত ৩টার দিকে আমরা ফেরিতে উঠলাম। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল, ফেরিতে কোনো জ্যাম ছিল না। সবাই ভয় দেখিয়েছিল, ফেরিতে বুঝি ৪-৫ ঘণ্টা দেরি হয়। ফরিদপুর, মাগুরা পেরিয়ে আমাদের পাইলট মহোদয় ঠিক ৬টায় নিয়ে এলেন যশোর বাসস্ট্যান্ডে। সাত-সকালে দেখি সাগর উপস্থিত আমাদের নিতে। আমরা সাগরের বাসা খড়কীতে গেলাম। সেখানে কিছু সময় বিরতি দিয়েই আবার বেরিয়ে পড়লাম। সাগর বারবার প্রাতরাশ করে বের হওয়ার কথা বলছিল, কিন্তু নতুন গন্তব্য দেখার জন্য মন পড়েছিল। আবার সকাল ৮টার ভেতর হাট শেষ হয়ে যায়। আমরা খড়কী থেকে আবার বাসে করে গদখালী বাজারে যাত্রা করলাম। ঝিকরগাছা বাজারের ভেতর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। বাজার পার হয়েই বেশ পুরনো এক ব্রিজ। এর নিচ দিয়েই বয়ে চলেছে মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত কপোতাক্ষ নদ। তবে এ নদ এখন কচুরিপানায় বন্দি। পথিমধ্যে সাগরকে জিজ্ঞাসা করলাম, গদখালী নাম কী করে হলো? ও বলল, কথিত আছে একসময় পর্তুগিজ ডাকাত সরদার রডারিক এ অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে মানুষের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল। একদিন সে স্থানীয় কমলেসের বাড়িতে হানা দেয়। সেখানে তাঁর সুন্দরী মেয়ে মাদালসার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় রডারিকের। মাদালসার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়। ক্ষমা চেয়ে প্রেম নিবেদন করে। পণ করে আর ডাকাতি করবে না। একপর্যায়ে মাদালসাদের বাড়ির পাশেই আশ্রয় নেয় রডারিক। আর মাদালসাকে পাওয়ার জন্য বাঘের সঙ্গে লড়াইও করে। এ ঘটনার পর মা কালীর নামে রডারিককে বরণ করে নেয় মাদালসা। পরে দুজনই সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে। তৈরি হয় একটি মন্দির। রডারিকের ‘গড’ আর মাদালসার ‘কালী’ নিয়ে এ মন্দিরের নাম হয় ‘গডকালী’ মন্দির। সেই নামের সূত্র ধরে পরে এ জায়গার নাম হয় ‘গদখালী’।

২০ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম আমরা গদখালী বাজারে। কুয়াশার চাদরে ঘেরা, তবু লোকে লোকারণ্য। আমরা গাড়ি থেকে নেমে ভ্যানগাড়ি নিলাম ঘুরে দেখার জন্য। যশোর-বেনাপোল রোড ছেড়ে ডানে, বাঁয়ের গ্রামগুলোর পথ ধরে এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে দিগন্তজোড়া ফুলের ক্ষেত। লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি আর সাদা রঙের এক বিস্তীর্ণ চাদর যেন বিছিয়ে রেখেছে চরাচরে। জমিতে ফুল চাষ করেন এখানকার চাষীরা। বাড়ির চারধারে শৌখিন ফুলের বাগান নয়। মাঠের পর মাঠজুড়ে ফুলের ক্ষেত। ফুলই এখানে ফসল। অনেকেই ফুলের রাজধানী বলে এ গদখালীকে। শুধু আমরাই না, দেখা মিলল আমাদের মতো বেশকিছু পর্যটকেরও। ফুলের সঙ্গে ছবি তুলতে তারা হাজির হয়েছেন। দেখা হলো সুইজারল্যান্ড থেকে আসা পর্যটক মেলিসা ও জিগালদিনের সঙ্গে। আমি একের পর এক ছবি তুলতে লাগলাম। পথের দুধারে গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, গাঁদা, জারবেরা ফুলের ক্ষেত। রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, গোলাপ আর গাঁদা ফুল চাষ হয় এখানে। সেখানে গেলে চোখে পড়বে কৃষকদের ব্যস্ততা। কেউ ফুল কেটে গরুর গাড়িতে করে বাজারে নিয়ে যাচ্ছে, সেখান থেকেই বান্ডিল করে চালান হয়ে যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে। পুরুষদের পাশে নারী ও শিশুরাও কাজ করছে ফুলের ক্ষেতে। কেউ ফুল কাটেছে, কেউ নিড়ানি দিচ্ছে। আবার কেউ ফুলের বীজ বুনচ্ছে। বাতাসে ফুলের মিষ্টি সৌরভ, মৌমাছির গুঞ্জন, প্রজাপতির ডানার জৌলুস আর রঙের অফুরান সৌরভের সামনে দাঁড়িয়ে বিশ্বাসই হতে চায় না জায়গাটা আমাদের রক্ত, ক্লেদ আর কোলাহলে ভরা মাটির পৃথিবীরই একটা টুকরা। আমাদের দেশের সর্ববৃহৎ ফুলের জোগান আসে এ গদখালী থেকে। মোট উৎপাদনের প্রায় ৭০ ভাগই আসে এখান থেকে। এখানেই বসে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফুলের পাইকারি বাজার। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এখানকার কৃষকরা ফুলের চাষ করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য লড়ে যাচ্ছেন।

ফুলের বাগান থেকে এক ভদ্রলোক আমাদের ফুল উপহার দিলেন। আমরা বাজারে এসে জলযোগ থেকে টাটকা সবজি দিয়ে তৈরি তরকারি আর লুচি খেলাম। অসাধারণ স্বাদ, ফরমালিনবিহীন। এরপর আমরা গেলাম সাগরের কর্মক্ষেত্র মৌমাছি স্কুলে। সেখানে শিশুদের সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা ছুটে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে।

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে যশোর সরাসরি বাস ছাড়ে গাবতলী থেকে। আর সিলেটের কদমতলী থেকে বাস ছাড়ে যশোরের উদ্দেশে। যশোর চাঁচড়া বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিকশা নিয়ে চলে যান লোকাল বাসস্ট্যান্ডে। এখান থেকেই পেয়ে যাবেন গদখালী যাওয়ার বাস। গদখালী নেমে ক্ষেত দেখার জন্য ভ্যান নিতে পারেন। ভ্যান ভাড়া নেবে ১০০-১৫০ টাকা। গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার দু’পাশে চোখে পড়বে ফুলের ক্ষেত। বাসস্ট্যান্ডের রাস্তার পাশেই সকালে বসে দেশের সর্ববৃহৎ ফুলের পাইকারি বাজার।