রোববার   ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আশ্বিন ৫ ১৪৩২   ২৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

ডালিয়ার পথে পথে 

নিউজ ডেস্ক

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৯:০২ পিএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮ শুক্রবার

ঢাকা থেকে তাড়াহুড়া করে বের হয়ে গেলাম। আর যা-ই হোক, বের হওয়ার মুহূর্তে মেজাজটা বিগড়াতে চাই না। ঢাকাকে জ্যামমুক্ত অবস্থায় বিদায় দিয়ে ভালো মুড নিয়ে যাত্রা করলাম। গন্তব্য ডালিয়া।

বহুদিন থেকে নাম শুনে শুনে ভাবি, পুরো এলাকায় বুঝি শুধু ডালিয়া ফুলের ছড়াছড়ি। আর তিস্তা ব্যারেজ, ওহ! সে বলার নয়, নদীর রাজনীতি, ভারত-বাংলাদেশ নদী সম্পর্ক, পানিবণ্টন, অর্থনীতি এবং কৃষি— কতকিছু যে জড়িয়ে আছে ওই শব্দ দুটোর মধ্যে! অথচ শোনার সঙ্গে দেখার সংযোগ ঘটল না এতগুলো বছরেও!

বরাবরের মতো গন্তব্য একটা হলেও উদ্দেশ্য ডালপালা ছড়ানো। পৌঁছতে যত সময় লাগে লাগুক— আমি বাবা হাজারে-বিজারে মাঠে-ঘাটে-ময়দানে ছবি তুলতে তুলতে যাব। তা-ই হলো। ভালো লাগে পুরনো দৃশ্যগুলোই। ভালো লাগে হলুদ সরষে ক্ষেত। ভালো লাগে শতবর্ষী বটগাছ। ভালো লাগে মাছ ধরা জেলে নৌকা। সবই পুরনো, তবু আমার কাছে পুরনো নয়। কেন, আমি জানি না।

বেরিয়েছিলাম সেই সকালে। কখন যে বেলা গড়িয়ে গেল সন্ধ্যার কোলে, বোঝা হলো না। যমুনা সেতু পার হতেই অসম্ভব ক্ষুধা। অ্যারিস্টোক্রেটে সামান্য খাওয়া সেরে নিলাম। পাশের গামছার দোকান থেকে চার-পাঁচটা গামছাও কেনা হলো। রংপুর থেকে সাংবাদিকরা বারবার ফোন দিচ্ছেন। পথে যেন আর দেরি না করি। তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর তাগিদ। উত্তরবঙ্গের কুয়াশা! সত্যি সত্যি গাড়ি চলতেই টের পেলাম চলাটা বিপজ্জনক। সামনে কিছুই দেখা যায় না। কী বিপদ! কবির দক্ষ ড্রাইভার। খুব ধীরে চালিয়ে এগোতে শুরু করল। শীতের ভয়ে কম্বল কাঁথা নিয়ে এসেছি।

সফরসঙ্গীরা সব কম্বলের ভেতর ফুরুৎ করে ঢুকে গেল। কিন্নরীর বয়স অল্প। টগবগে রক্ত। ও কুয়াশা ধরবে বলে মাঝে মধ্যেই জানালার গ্লাস নামিয়ে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। শুভ্র বললো, তুই বরং মুখটা বাড়িয়ে কুয়াশা খেতে খেতে যা। যে-ই কথা সেই কাজ। আর আমরা মাঝখান থেকে ঠাণ্ডায় বুঝি কুয়াশাই হয়ে যাচ্ছি।

বগুড়ায় পৌঁছে গাড়ির চাকা বসে গেল। চাকায় ভালোমতো সমস্যা হয়ে গেছে। ঝামেলা শেষ করতে লেগে গেল প্রায় ঘণ্টাখানেক। চাকা সারানোর দোকানে ওরা বেশ আয়েশ করে বসে গেল আড্ডা পেটাতে। সঙ্গে চা-বিস্কুট আর চানাচুর। আমার এসব চলে না। অগতির গতি ছবি তোলা।

রংপুরকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি চলে যাব ডালিয়া, নাকি শহর হয়ে যাব! সাড়ে ১১টা বাজে। কিছু খেয়ে নেয়া উচিত। এত রাতে ডালিয়ায় পৌঁছে খাবার কিছু পাওয়া যাবে না। তাই গাড়ি শহরমুখী হলো। পরিচিত রেস্তোরাঁয় উষ্ণ আতিথেয়তা। আসার আগাম সংবাদে মাছ ভাজা, মাছের ঝোল, মুরগি ভুনা, করলা ভাজি, বেগুন ভাজি, মলা-ঢেলার চচ্চড়ি— আরো? আরো ছিল, কিন্তু এত খাওয়া সম্ভব নয়। দলের মধ্যে বিশাল বপুধারী একা শুভ্র। ও সাপ্টে দিল মোটামুটি সব। গরম ডালটাও এমন চেটেপুটে খেল। কিন্নরী হতবাক— ‘মামা তুমি এত খাও কীভাবে!’ শুভ্র— হি হি হি পেটে হাত দিয়ে— ‘এই টুকুতেই!’

রংপুর থেকে পাগলাপীর হয়ে জলঢাকা, তারপর ডালিয়ার পথ। চলছি তো চলছি। চলছি তো চলছি। ঘড়িতে রাত ১২টা বেজে ৪৫ মিনিট। পথের শেষ কোথায়? গা ছমছম রাত্রি। দূরে কোথাও সামান্য আলোর চিহ্নও নেই। কালেভদ্রে স্থলসীমান্তের উদ্দেশে ট্রাকগুলো ভুশ ভুশ করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। ওগুলোই আত্মার মধ্যে সামান্য শান্তির হাওয়া বুলিয়ে দিচ্ছে। চারপাশে কয়েক মাইল এলাকা সুনসান জনশূন্য।

সীমান্ত প্রহরীদের একটা গাড়ি লাল-সবুজ আলো জ্বালাতে জ্বালাতে নিভাতে নিভাতে চলল। আমরা তার পিছু পিছু। ওমা! ওটাও ভুষ করে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সত্যি সত্যি উধাও! আবার অন্ধকারে পথ হাতড়ে চলা। এই গা ছমছমে রাত আর নিকষ কালো পথ বুঝি আর শেষ হওয়ার নয়। রংপুর থেকে ৪৫ মিনিটের পথ। পুরো দেড় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে হঠাৎ করেই পথের মধ্যে একটা দরজা এসে হাজির। খোলা। দরজা গলে গাড়ি ভেতরে ঢুকে গেল। ডানে-বাঁয়ে কিছু দেখছি না। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা বাংলো মতোন দেখতে পেয়ে আমরা ঠিকানা ভেবে ধুপধাপ নেমে পড়লাম। শুভ্র, তুষার সব যে যার মতো হাঁকডাক শুরু করে দিল। কেউ আছেন ভাই, প্লিজ দরজাটা একটু খুলবেন? কারো কোনো শব্দ নেই। কী রে বাবা কোথায় এলাম! এটাই তো কাঙ্ক্ষিত রেস্ট হাউজ, নাকি?

অনেকক্ষণ ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি— একজন টিংটিং মতো মানুষ সামনে এসে দাঁড়াল, রেস্ট হাউজ ওইদিকে। মানে পেছনে ফেলে এসেছি। আজব, দেখতেই পেলাম না! আবার পেছনের পথ। বিশাল এক ফটকের সামনে শুরু হলো ডাকাডাকি। কোথাও কেউ নেই। গাড়ির তীব্র হর্ণে খানখান হয়ে গেল কুয়াশাচ্ছন্ন ধোঁয়াটে নিস্তব্ধ রাত্রি। একজন নৈশপ্রহরী এগিয়ে এলেন। দরজা খুলতে বলেই তিনি জানালেন, কেয়ার টেকার কাম সুপারভাইজর আমাদের জন্য অপেক্ষা করে চলে গেছেন। তার বাসস্থান দূরে। মাথায় বাজ। এই ঠাণ্ডায় বাইরে রাত কাটাতে হবে। এও কি সম্ভব! কান্না পাচ্ছে। রোমাঞ্চও হচ্ছে। মনে হচ্ছে, থাক কারো আসার দরকার নেই। বারান্দায় কম্বল বিছিয়ে চেয়ে দেখি অদ্ভুত, বড় অদ্ভুত এই রাত্রি! যোগাযোগের পর যোগাযোগ। রক্ষা হলো। আমাদের গাড়ি দিয়ে তাকে আমরা আনতে গেলাম। সুপারভাইজর ভাই এলেন!

খুলে গেল গভীর রাতে তিস্তা পাড়ে ডালিয়ার মূল দরজা। দেখলাম, কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা হিম শীতল বিশাল অট্টালিকা। বখাটে অতিথিদের সম্ভাষণ জানাল যেন সামান্য তিরস্কারের হাসি হেসে। এই সেই বহু গল্পময় ডালিয়া!

বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে আমরা সত্যি ক্লান্ত। নরম বিছানা আমাদের ডাকছে। যে যার বিছানায় ঝাঁপ এবং ঘুম।

ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। মনে হয় অনেক পাখি। আমাকে ডাকছে।

আমাকে ডাকছে ভোরের পাখি

ডাকছে ভোরের আকাশ, ভোরের বাতাস

ভোরের শিশির, চিকচিকে আলো

ডাকছে নদী-হ্যাঁ তিস্তা নদীর পাড়

সামনেই তিস্তা! হাত বাড়ালেই নীল জল।

এত সুন্দর কেন? ভোরের আলোয় কর্মমুখর

তিস্তা পাড়ের মানুষ। আমার চোখ পড়ে না।

চোখের পাতা ফেললেই বুঝি হারিয়ে যাবে।

কেন যে এত সুন্দর আমার এই দেশ!

এত সুন্দর তাই বুঝি অনাদরে অবহেলায়

স্তব্ধ আমার বাংলাদেশ। আমরা যার খবরও রাখি না।