মঙ্গলবার   ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫   ভাদ্র ১৭ ১৪৩২   ০৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

ইসলামে মদ, জুয়া, বেদী, ভাগ্য নির্ধারক শর নিষিদ্ধ

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৩:২৮ পিএম, ১৭ জুলাই ২০১৯ বুধবার

‘মদ, জুয়া, পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ধারক শর সমূহ শয়তানের নাপাক কর্ম বৈ কিছুই নয়।’ 

পবিত্র কোরআনুল কারিমে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالأَنصَابُ وَالأَزْلاَمُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ- إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوْقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاء فِيْ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ اللهِ وَعَنِ الصَّلاَةِ فَهَلْ أَنْتُم مُّنْتَهُوْنَ-

 

‘হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ধারক শর সমূহ শয়তানের নাপাক কর্ম বৈ কিছুই নয়। অতএব এগুলো থেকে বিরত হও। তাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হবে’। ‘শয়তান তো কেবল চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে পরস্পরে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও ছালাত হ’তে তোমাদেরকে বাধা প্রদান করতে। অতএব তোমরা নিবৃত্ত হবে কি?’ (সূরা: মায়েদাহ, আয়াত: ৯০-৯১)।

 

উপরোক্ত আয়াতে প্রধান চারটি হারাম বস্ত্ত হতে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, সূরা মায়েদাহ কোরআনের শেষ দিকে নাজিল হওয়া সূরা সমূহের অন্যতম। অতএব এখানে যে বস্ত্তগুলো হারাম ঘোষিত হয়েছে, সেগুলো আর মনসূখ হয়নি। ফলে তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত চিরন্তন হারাম হিসাবে গণ্য। অসংখ্য নিষিদ্ধ বস্ত্তর মধ্যে এখানে প্রধান চারটির উল্লেখ করার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, এ চারটি হারাম বস্ত্ত আরো বহু হারামের উৎস। অতএব এগুলো বন্ধ হলে অন্যগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে।

(১) الْخَمْرُ অর্থ মদ। خَمَرَ يَخْمُرُ خَمْرًا অর্থ سَتَرَ গোপন করা। ওড়নাকে আরবিতে ‘খেমার’ (خِماَرٌ) বলা হয় এজন্য যে, তা মহিলাদের মাথা ও বুক আবৃত করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, خَمِّرُوا الآنِيَةَ وَاذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَيْهَا ‘তোমরা তোমাদের পাত্র সমূহ ঢেকে রাখ এবং তার ওপরে আল্লাহর নাম স্মরণ কর’। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪২৯৪; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/১২৩৪)। 

 

হজরত ওমর ফারুক (রা.) বলেন, الْخَمْرُ مَا خَامَرَ الْعَقْلَ ‘মদ তাই, যা মানুষের বিবেককে আচ্ছন্ন করে’। (বুখারী হা/৪৬১৯; মুসলিম হা/৩০৩২; মিশকাত হা/৩৬৩৫)। 

সে সময় আরব দেশে আঙ্গুর, খেজুর, মধু, গম ও যবসহ পাঁচটি বস্ত্ত থেকে মদ তৈরী হত। (বুখারী, আবূদাঊদ হা/৩৬৬৯)। তবে প্রধানত: আঙ্গুর থেকেই সচরাচর মদ তৈরী হত। যেমন বলা হয়েছে, النَّيُّ مِنْ مَاءِ الْعِنَبِ إِذَا غَلاَ وَاشْتَدَّ وَبَلَغَ حَدَّ الْإِسْكَارِ ‘মদ হলো আঙ্গুরের কাঁচা রস যখন পচে গরম হয় এবং ফুলে ফেনা ধরে যায় ও চূড়ান্ত নেশাকর অবস্থায় পৌঁছে যায়।’

আঙ্গুরের কাঁচা রস পচে ফেনা ধরে গেলে তাতে নেশা সৃষ্টি হয়, যাতে মানুষের স্বাভাবিক বিবেক-বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পচা-সড়া জিনিষ দিয়ে মদ তৈরী হয়। যেমন বাংলাদেশে পচা পান্তা, পচা খেজুর রস, তালের রস ইত্যাদি দিয়ে দেশি মদ ও তাড়ি বানানো হয়। এছাড়াও রয়েছে তামাক, গাঁজা, আফিম প্রভৃতি বহু প্রাচীন মাদক সমূহ। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে হিরোইন, ফেন্সিডিল, ইয়াবা ট্যাবলেট, পেথিড্রিন ইনজেকশন ইত্যাদি নানাবিধ নেশাকর বস্ত্ত নামে-বেনামে তৈরী হচ্ছে। যা সবই এক কথায় মাদক দ্রব্য বা মদ। মদ সাময়িকভাবে দেহের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করলেও চূড়ান্তভাবে তা মানুষকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করে।

 

মদ হারাম হওয়ার বিবরণ: ইসলাম মানুষের স্বভাবধর্ম। মানুষ সাধারণত নেশার গোলাম। তাই মানুষের স্বভাব বুঝে আল্লাহ ক্রমধারা অনুযায়ী এটাকে নিষিদ্ধ করেছেন। শিশুকে বুকের দুধ ছাড়াতে মা যেমন ধীরগতির কৌশল অবলম্বন করেন, স্নেহশীল পালনকর্তা আল্লাহ তেমনি বান্দাকে মদের কঠিন নেশা ছাড়াতে ধীরগতির কৌশল অবলম্বন করেছেন। সে সময় আরবরা ছিল দারুণভাবে মদে অভ্যস্ত। মদ্যপান ছিল সে যুগে আভিজাত্যের প্রতীক। আরব-আজম সর্বত্র ছিল এর ব্যাপক প্রচলন। তাই ইসলাম প্রথমে তার অনুসারীদের মানসিকতা তৈরী করে নিয়েছে। তারপর চূড়ান্তভাবে একে নিষিদ্ধ করেছে। আর যখনই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, তখনই তা বাস্তবায়িত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এজন্য কোনো যবরদস্তি প্রয়োজন হয়নি।

মদ নিষিদ্ধের জন্য পরপর তিনটি আয়াত নাজিল হয়। সূরা বাক্বারাহ ২১৯, সূরা নিসা ৪৩ ও সবশেষে সূরা মায়েদাহ ৯০-৯১। প্রতিটি আয়াত নাজিলের মধ্যে নাতিদীর্ঘ বিরতি ছিল এবং মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনের অবকাশ ছিল। প্রতিটি আয়াতই একেকটি ঘটনা উপলক্ষে নাজিল হয়। যাতে মানুষ নিষেধাজ্ঞার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাকে সহজে গ্রহণ করে নেয়। যেমন (১) কিছু সাহাবি এসে মদের অপকারিতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং এ বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশ কামনা করেন। তখন নাজিল হয়,

 

يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيْهِمَا إِثْمٌ كَبِيْرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِن نَّفْعِهِمَا- (البقرة ২১৯)-

‘তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। আপনি বলে দিন যে, এ দু’টির মধ্যে রয়েছে বড় পাপ ও মানুষের জন্য রয়েছে কিছু উপকারিতা। তবে এ দু’টির পাপ এ দু’টির উপকারিতার চাইতে অধিক’ (সূরা: বাকারা, আয়াত২১৯)। এ আয়াত নাজিলের ফলে বহু লোক মদ-জুয়া ছেড়ে দেয়। তবুও কিছু লোক থেকে যায়।

অতঃপর (২) একদিন এক ছাহাবীর বাড়ীতে মেজবানী শেষে মদ্যপান করে একজন অজ্ঞান হয়ে পড়েন। অন্যজন সালাতে ইমামতি করতে গিয়ে সূরা কাফিরূণে نَحْنُ نَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ পড়েন। যার অর্থ ‘আমরা ইবাদত করি তোমরা যাদের ইবাদত কর’। (তিরমিযী হা/৩০২৬)। যাতে আয়াতের মর্ম একেবারেই পরিবর্তিত হয়ে যায়। তখন আয়াত নাজিল হয়,

 يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لاَ تَقْرَبُوا الصَّلاَةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى حَتَّى تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ- (النساء ৪৩)- 

‘হে মুমিনগণ! তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না। যতক্ষণ না তোমরা যা বল তা বুঝতে পার।’ (সূরা: নিসা, আয়াত: ৪৩)। এ আয়াত নাজিলের পর মদ্যপায়ীর সংখ্যা আরো হ্রাস পায়।

পরে (৩) একদিন জনৈক সাহাবীর বাড়ীতে খানাপিনার পর মদ্যপান শেষে কিছু মেহমান অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এ সময় জনৈক মুহাজির সাহাবী নিজের বংশ গৌরব কাব্যাকারে বলতে গিয়ে আনছারদের দোষারোপ করে কবিতা বলেন। তাতে একজন আনছার যুবক তার মাথা লক্ষ্য করে উটের হাড্ডি ছুঁড়ে মারেন। তাতে তার নাক মারাত্মকভাবে আহত হয়। পরে বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট পেশ করা হয়। তখন সূরা মায়েদাহর আলোচ্য আয়াতদ্বয় নাজিল হয়। (মুসলিম হা/১৭৪৮; বায়হাক্বী ৮/২৮৫)।

হজরত আনাস বিন মালেক (রা.) বলেন, সাহাবি আবু ত্বালহা আনসারীর বাড়ীতে মেজবানী শেষে ‘ফাযীহ’ (الفضيح ) নামক উন্নতমানের মদ্যপান চলছিল। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পক্ষ থেকে একজন ঘোষক উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা দিয়ে যান أَلاَ إِنَّ الْخَمْرَ قَدْ حُرِّمَتْ ‘হুঁশিয়ার হও! মদ হারাম করা হয়েছে’। (বুখারী হা/২৪৬৪, মুসলিম হা/১৯৮০; আবুদাঊদ হা/৩৬৭৩)।