নড়াইলের মাশরাফি, বাংলাদেশের মাশরাফি
খেলা ডেস্ক
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৩:৫৫ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার
ইয়ান বোথাম কিংবা টেন্ডুলকারের ঝলমলে ক্যারিয়ার ম্লান করেছিল অদক্ষ নেতৃত্ব। তবে তার উল্টো পিঠে মাইক ব্রিয়ারলি। ক্যাপ্টেন্সি গুনে রাতারাতি হিরো বনে যান ইংলিশ ক্রিকেটার। ছাড়িয়ে যান সতীর্থদের। নজির গড়েন বিশ্বক্রিকেটে এবং ছাপ রাখেন ইংল্যান্ড মানচিত্রে।
২২ গড়ের একজন ব্যাটসম্যানের হাতে ক্রিকেট আবিষ্কাকারক ইংল্যান্ড দলের আর্মব্যান্ড। নেতৃত্বকালে যার সিংহভাগ ম্যাচেই (৩১) এসেছে জয়,পরাজয়গুলোও কূলে এসে তরী ডুবানোর। তাই আজও ব্রিয়ারলি নাম শুনেই পিলে চমকে যান অজস্র অনুরাগী। অবিচল, ট্যাকটিকালি ধূর্ত, তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শিতার গুণে ব্রিয়ারলি ছিলেন আদর্শ অধিনায়ক। এমনকী তার স্থান মিলে ব্যাড ম্যানের পাশেই। ম্যাচের ভাগ্য যখন সুতোর ওপর ঝুলছে, সতীর্থরা যখন উত্তেজনায় জবুথবু তখনও তিনি নিষ্কম্প, মূর্তিমানবরুপী ‘ক্যাপ্টেন কুল’। মাইক ব্রিয়ারলি ক্রিকেট অধ্যায় চুকে মেন্টর-সাইক্রেটিস্টের ভূমিকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ক্রিকেটবিশ্বে যেখানে সমস্যা, সেখানেই হাজির ইংলিশ কিংবদন্তি।
খুব বেশি বাড়াবাড়ি না হলে ইংল্যান্ড কিংবদন্তি ব্রিয়ারলির সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় ওয়ানডে দলের ক্যাপ্টেন মাশরাফি বিন মর্তুজাকে তুলনা করতে চাই। মানুষকে কনভেন্সের নিঁখুত দক্ষতা, ধূর্ততা কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের কৌশল; সবই বিদ্যমান নড়াইলের মাশরাফির মাঝে। তার মন-মঞ্জিলে সবর্দা পতপত করে ওঠে লাল-সবুজের পতাকা। তার শক্তির উৎসে জুয়েল-রুমী। আদর্শে-বঙ্গবন্ধু। চেতনায়-৭১। মা-মাটি ও দেশসেবার বুলি মাশরাফির মুখে।
ফ্লাশব্যাকে একটু পেছনে ফিরলেই স্পষ্ট কেন মাশরাফিকে কিংবদন্তির কাতারে ফেলা। কারণ ম্যাশ এক বিশাল আকাশের নাম। যেখানে বেদনার মেঘ ঘনিভূত হয়ে ভালোবাসার রোদ উঠে রোজ সকালে। ২০০১ সালে টাইগার ক্রিকেটের সঙ্গে পদচলা শুরু হয় নড়াইল এক্সপ্রেস খ্যাত মাশরাফির। সে পথচলা আজও চলমান। একে একে টেস্ট-টি টোয়েন্টি থেকে সরে দাঁড়িয়ে ওয়ানডে জার্সিও আলমারিতে তুলে রাখার অপেক্ষায়। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০১৯ বিশ্বকাপই হবে তার ক্যারিয়ারের শেষ টুর্নামেন্ট। কিন্তু তার আগেই রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছেন। মূলত ছোটবেলার লালিত স্বপ্ন ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজের আসন নড়াইল-২ থেকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাসি।
রাজনীতিতে নাম লেখানোর কারণে মাশরাফির তুমুল জনপ্রিয়তায়ও কিছুটা ভাটা পড়ে। তারপরও আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে থাকা বিষম চাপ সামলে নেন আপোষহীন। ১৮ বছরের ক্যারিয়ারে যেমনি তার আপোষের উর্ধ্বে ছিল ইনজুরি। সাত-সাতবার ছুরি-কাঁচির নিচে বসেও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন দ্বিগুণ শক্তিতে। আগ্রাসী হয়েছেন পূর্বের চেয়ে। যেমনটা শিকারির আস্ত্রে আঘাত পেয়ে দ্বিগুণ আগ্রাসী হয় বনের বাঘ। তার বার বার ফিরে আসাটাও ছিল আশ্চর্যের। যেমনটা চমকে গিয়েছিলেন স্বয়ং চিকিৎসক ডেভিড ইয়াং। তার কণ্ঠে প্রায়ই উচ্চারিত হতো, ‘ইটস আ মিরাকাল ম্যান, মেডিক্যাল সাইন্স ইজ জাস্ট স্পিচলেস, ইয়ু মেড রিয়েলি মিরাকাল মাই সান!’
হ্যা, মিরাকলই বটে! ক্যারিয়ারের মতো মাশরাফির রাজনীতে যোগদান ‘মিরাকাল’। সামাজিক দায়বদ্ধতায় ‘বিষম চাপের’ মাঝেও অকুতোভয় বীরের মতো অনঢ় মাশরাফি নেমেছেন সংসদ নির্বাচনে। ভক্তরা যাতে তাকে না ভুলে যায় সে জন্যই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত তার। সেটা মাশরাফির কথাতেই স্পষ্ট। ‘না আমি শচীন টেন্ডুলকার, না আমি ম্যাকগ্রা যে আমার কথা মানুষ স্মরণ রাখবে। আমি আমার মতো করেই ক্রিকেটটা খেলেছি। আমার স্ট্রাগলিং লাইফে যতটুকু পেরেছি, খেলেছি। তবে আমি সবসময় উপভোগ করেছি মানুষের জন্য কাজ করতে পারা। এটা আমার ছোটবেলার শখ ছিল বলতে পারেন।'
ক্যাপ্টেনের নির্বাচনে আসার ঘোষণায় অনেকে দুয়োধ্বনি তুলেছেন। বলেছেন, ‘নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন’ থেকেই তো তিনি মানুষের সেবা করতে পারতেন। কি দরকার ছিল নোংরা রাজনীতিতে জড়ানোর। যেমনটা কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি হয়েছিল পাকিস্তানের ইমরান খান, শ্রীলঙ্কার অর্জুন রানাতুঙ্গা-জয়সূরিয়া কিংবা ভারতের আজহার আলীকে নিয়ে। ক্রিকেটীয় জীবনে পাকিস্তানে ইমরান খানের হেটার্স তো দূরের কথা, অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও তার সমলোচক খুঁজে পাওয়া ছিল মুশফিক।
কিন্তু যখনই ইমরান তেহরিকই ইনসাফের ব্যানারে রাজনীতিতে নামলে তখনই তার জনপ্রিয়তা অর্ধেকে নেমে আসে। আর ‘ক্যাপ্টেন কুল’ রানাতুঙ্গার গল্পও করুণ। গোটা ক্যারিয়ার দেশসেবায় নিয়োজিত থাকা লঙ্কান অধিনায়ক যখন রাজনীতিতে জড়ালেন তখনই তাকে নিয়ে শুরু হয় হট্টগোল। কিন্তু এখন তারা রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। মেধা-শ্রমে বেঁকে বসা ভক্তদেরও পুনরায় মন জয়ে সফল। আশা করা যায় আমাদের মাশরাফির বেলায়ও তেমনটা ঘটবে। ইতোমধ্যে তার নির্বাচনী এলাকায় গণমানুষের জোয়ার নেমেছে। দল-মত নির্বিশেষে মাশরাফিকে জয়ের মালা পরাতে প্রস্তুত সবাই।
সবশেষ মাশরাফির কাছে আশা, ২০১৪ সালে হারের বৃত্তে মুহ্যমান বাংলাদেশকে ক্যাপ্টেন যেভাবে আপন করে নিয়েছেন। যেখানে সাকিব-তাসকিনদের বিপদে-আপদে বুকে টেনে নিয়েছেন। যে টনিকে সুদোয় ঝুলতে থাকা ম্যাচকে নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। এমনকি যে গুণে নিজে রোল মডেল হয়েছেন, দলকে বিশ্বমানচিত্রে জায়গা করে দিয়েছেন। ঠিক তেমনই ইমরান খান, মাইক ব্রিয়ারলি ও রানাতুঙ্গার মতো ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে দেশের উন্নয়নে এবং জাতীয় স্বার্থে কাজ করবেন।
